সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫

গুরুচণ্ডালী (পাদুকার প্রত্যাবর্তন )

বহুকাল পরে( তা মাসখানেক তো হইবেই) যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম তখন রীতিমত সাড়া পড়িয়া গেলো। মাতা ও ভগ্নীরা দহলিজের বাহির হইতেই আপাদমস্তক জরিপ করিতে লাগিলেন। মস্তকের ইস্ক্রুপ ঘটিত সমস্যাদি তাহারা জানিতেন বলিয়া খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। তবে পদদ্বয় দেখিয়া মাতা ফুকারিয়া কাদিয়া উঠিলেন আর ভগ্নীদের মুখও চুন হইয়া গেলো।  কারনটি সামান্যই, পায়ে একজোড়া নিন্মবর্গীয় পাদুকা।

ঘটনাখানি এরুপ, মাতা ইতিপূর্বে অর্থাদি প্রেরন করিয়া বারংবার একজোড়া সুদৃশ্য পাদুকা ক্রয় করিয়া এ পুত্রকে নিজের পদোন্নতি করিতে আজ্ঞা করিয়াছিলেন। আমি কুপুত্র তাহা নয়ে ছয়ে চুয়ান্ন করিয়া ফেলিয়াছি। এদিকে কত রাম ,শ্যাম ,রহিম, করিম, যে বহুমূল্য পাদুকা পড়িয়া মসমসাইয়া চলিয়া পটপটাইয়া কথা কহিয়া দুনিয়া ভাজিয়া খাইলো তাহা বলিতে বাকি রাখিলেন না।বুঝিলাম, মস্তক যে চুলোতেই যাক উহাদের পদোন্নতি হইতেছে এবং হইবে। এদিকে তাহার 'লাল' ই কেবল মুখচোরা রহিল গো! রাজ্যের পুঁথি পড়িয়া  ইহার মস্তক বিগড়াইয়াছে। মস্তক ছাড়িয়া পদের যে কিছু করিবেন তাহাও দুরাশা। যে বাহ্যে যাবার নিচুজাত পাদুকা পড়িয়া ভ্রমনে বাহির হয় তাহার জীবনের আশায় ঢ্যারা পড়িয়াছে ইহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

ইত্যবসরেই আমি যে কিরুপ কালকাশ  সদৃশ রোগা হইয়া গিয়াছি এবং আমার গৌরবর্ণ (!)  রং কিরুপ পুড়িয়া গিয়াছে উহারা তাহা লইয়া পড়িলেন। একদিকে আমি ভীমের মত খাইয়া আর কুম্ভকর্ণ এর ন্যায় নিদ্রায় স্ফীতোদর হইয়াছি। অন্যদিকে জন্মান্তেই যে কয়লাকান্তি রুপ লইয়া জন্মিয়াছি তাহারও কোনরুপ ক্ষয় হয় নাই। মনে মনে কহিলাম "আমি কালো হইয়া যাই নাই, কালো থাকিয়া গিয়াছি, এই যা।"ইহাতে এরুপ কোলাহলের কি আছে! বুঝিতে না পারিয়া মৌন হইলাম।

কেবল নিজের কথাই বলিতে এই খটমটে গুরুচন্ডালী খুলিয়া বসি নাই তাহা বলিলে মিথ্যাচার হইবে। এ আমার একান্ত নিজস্ব কথন।  ভালো না লাগিলে দূরে গিয়া মুড়ি ভক্ষন করিলেই খুশি হইবো।

এইবারের যাত্রাখানা বড় অম্লমধুর ছিলো সে ব্যাপারে সন্দেহ নাই। প্রথমত,  শ্যালকের পুত্ররা লিখিত পরীক্ষায় নানা রকম ফ্যাকড়া বাধাইয়াছিলো। সময়সূচী দেখিলেই উহাদের খুরে প্রনাম জানাইতে হয়। দিতীয়ত পেশাগত পরীক্ষায় নানা পেশা অবলম্বন করিতে হয় (চৌর্যবৃত্তি, নকলনবিশি ইত্যাদি)। এই মহাসত্য জানিয়াও  দুই শশ্রুমন্ডিত বারবনিতার পুত্র আমাদের মহাযজ্ঞে বাগড়া দিয়াছিলো। তাহাদের বিচার ঈশ্বর করিবেন। গায়েবী ও পার্শ্বীয় সহযোগীতায় গোটা চারেক কুম্ভীপাক পার হইলাম।

তবে সর্বশেষ পরীক্ষায় সে এক পরিস্থিতিরই উদ্ভব হইলো। আজও গা শিহরিয়া উঠিতেছে। পূর্বদিনে প্রশ্নপত্র আগমনীর বাজনা উঠিলো বাজি। সে বাদ্যে আনপড় নাচুনে বুড়ো বুড়িরা ঝাপাইয়া পড়িয়া 'নাচমেঝে' কাপাইয়া দিলো। আমার কক্ষবন্ধু  'মহাধিনায়ক নিধিরাম' অগ্নিতে নুন ঘৃত দিয়া জনতার উল্লাসকে  উৎসবে পরিনত করিয়া দিলো। আরেক কক্ষবন্ধু 'কুম্ভকর্ণ' দিবারাত্র দক্ষিণী ছায়াছবি দেখিয়া আর নিদ্রা যাইয়া সকলের অধ্যয়নাদি দু:সাধ্য করিয়া তুলিলো।

তাতে অবশ্য লাভ বিশেষ হইলো না।

রাত্রির শেষ প্রহরে মহাধিনায়ক  মুঠোফুন মারিতেই প্রশ্নবাবা কহিলেন " খোকা,প্রশ্ন তো  বাঘ শিকারে সুন্দরবন গিয়াছে। ফিরিলে সাক্ষাৎ হইবে।"

মহাধিনায়ক শিরে আঘাত করিয়া ক্ষীন আওয়াজে কহিলো "হইলো না" ইহার পর বিভীষনজাত সহপাঠিনীকুল আর প্রশ্নবাবার প্রতি যেসব 'মধুর' বাক্য প্রয়োগ করিলো তাহা সে কলাপ মুগ্ধবোধে শেখে নাই তাহা বলাই বাহুল্য।

নিদ্রিত  ছাত্রজনতা জাগ্রত হইয়া হু হুংকারে কাদিয়া উঠিল, 'হায়! তাহারা কি এই দেশ চাহিয়াছিলো। যে দেশে সামান্য প্রশ্নফাঁস এর নিশ্চয়তা নাই সে দেশের হইবে কি!"

 যাহাই হোক বিভিন্ন পেছনের দরজা ব্যবহার করিয়া প্রথম পরীক্ষার মুখাগ্নি আর শেষখানার পশ্চাৎ ছারখার করিয়াই  বাহির হইলাম।

মুক্তকেশ হইয়া স্বগৃহে ফিরিব। আমার  বন্ধুবর , যিনি এ মহাবিদ্যালয়ের অন্যতম 'উর্বশীর অভিশপ্ত অর্জুন', তিনিই যাত্রার ব্যবস্থা করিলেন। পরে জানিলাম , হায়!আমার সর্বনাশ হইয়াছে।ভয়ে প্রান উড়িয়া গেল। এ দেখি 'হংস মধ্যে গুগলি যথা' বিচরন করিতে হইবে। যাহাকে দেখিলে বায়ুস্তরের সমস্ত অম্লজান উড়িয়া যায় বলিয়া মনে হয় তাহার সহিত যাত্রা করা, নৈব চ নৈব চ। কিন্তু ইহার  কারন আজও খুঁজিয়া পাইলাম না।কম তো ভুগাইলো না।মগজকে প্রশ্ন করিলে কহে ''রসো কাকা,অনুসন্ধান চলিতেছে।'' তাইতে আবার সংগী আরেক সহপাঠী 'বিচিত্রবীর্য' । এ দুইয়ে মিলিয়া আমার 'পা টানিয়া' রংগ রহস্যে আর কিছু রাখিবে না। দমাদম মানসিক আছাড় খাইবো।

এদিকে বন্ধুরূপী শত্রু বুরবকদিগকে যাহাই বলি না কেন তাহা লইয়াই ইহারা রঙ্গ করিয়া সারা হয়। আমি উহার প্রেমে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছি এই প্রচারে ইহারা অক্লান্ত।  মনে মনে কহি "প্রেম ফ্রেম হইলে তো বাঁচিয়াই যাইতাম। দর্শনের  লাইফবোট খরিদ করিয়া তীরে আসিয়া প্রেমকে মুখ ভ্যাংচাইতাম।উহা আমি ভালো পারি। যাহা হইয়াছে তাহা পাভলভ, ফ্রয়েডে ব্যাখা করিতে হয়। জ্ঞানও নাই সাহসও হয় না। ব্যাখা করিতে গেলে ঠ্যাঙানী খাইবার সম্ভাবনা অতি উচ্চ। তবে তত্ত্ব যুক্তি শুনিতে ইহারা রাজি না। অঙ্কও বোধহয় কম শিখিয়া থাকিবে।অমুক যোগ তমুক করিতেই ইহাদের উৎসাহ। এ শালারা বিয়োগ জানিলে বড় ভালো হইতো। সব হইতে আমাকে বিয়োগ করিলেই খুশি হইতাম।"

যাহাই হোক এ আকাঁড়া বাজারে কে টিকিট ক্রয় করিবে? আমার  কোন শ্যালক! 'যা থাকে ললাটে' বলিয়া  যাত্রা করিলাম।

উহারা যথাবিহিত যত্নপূর্বক আমার মানসিক দেহের সৎকার করিলেন। মানে যেটুকু অবশিষ্ট রহিল তাহা অকিঞ্চিৎকর। পরে পারাপারের  জলশকটে চড়িয়া নানা কায়দায় নিজস্বী তুলিতে ব্যতিব্যস্ত হইয়া গেলেন। চোখ বুজিয়া আমিও কয়েকটিতে চলিয়া আসিলাম। (ষড়যন্ত্র এর ফল, আর এমনিতেই আমার চৈনিক চক্ষু)।মুখপঞ্জিকায় বিস্তর হাসাহাসি হইল। দেখিয়া দু:খে দার্শনিক হইয়া গেলাম।

যাহাই হোক, শেষমেষ আসিয়া পৌঁছাইলাম শৈশব সমাপ্তির শহর ঢাকায়। যাদুর শহর, যে শহর অদ্ভুত মন্ত্র পড়িয়া আমাকে টুকরা টুকরা করিয়া জীবনপথে ছুড়িয়া ফেলিয়াছে। যে শহরে একটা ছেলে বড়মানুষদের ভীড়ে হারাইয়া ক্রমাগত নিজেকে খোঁজে।তার স্বপ্নগুলো অলিতে গলিতে অন্ধ ভিখিরীর মতোন বস্তবের কাছে হাত পাতে। মাধুকরীর এ জীবন বড় অসহ্য লাগে সময় সময়।

পাদুকার কথায় ফিরিয়া আসিতে হইতেছে। আশৈশব খালি পায়ে দৌড়াইয়া বেড়াইয়াছি। পথে ঘাটে অলিতে গলিতে খেলিয়া ঘুড়ি উড়াইয়া, লাটিম ঘুরাইয়া দিন পার হইয়াছে। হতদরিদ্র সে শৈশব খুব খারাপ ছিল বলিলে মাথায় বজ্রাঘাত হইবে।

শৈশব ছিল বিস্ময়। বনদেবীর আঁচলের তলায় যে শৈশবের শুরু তাতে চিন্তার প্রসারতা ছিলো। সত্যিকার বন্ধুরা ছিলো।তাহারা কে কোথায় হারাইয়া গেলো আর খুঁজিয়াই পাইলাম না।  টাকা- ক্ষমতার লড়াই,ফটকাবাজির ধাধা,  অন্যকে ছোট করিয়া নিজে বড় হইবার প্রাণান্তকর চেষ্টা এসব ছিলো না।কয়েক দিগন্ত ফিরোজা নীল আকাশ ছিলো, মাঝদুপুরে স্কুলপালানো বনঝোপের সবুজ ছিলো। এখনকার অনেক পরিচিতকে দেখিলে নিজের উপরই বিবমিষা জাগে। আমিও বোধকরি ইহাদের মতোই হইয়া গিয়াছি। তবে এটুকু সত্য, যাদের আজকাল বন্ধু বলিয়া জানি তাহাদের অনেকেই মনের সদর দরজাও পার হইতে পারে নাই। অন্তরে প্রবেশের রাস্তাটা কি শৈশবেই বন্ধ হইয়া যায়?

তা না হইলে এর পরের সমস্ত সম্পর্ক কেমন যেন মেকি বোধ হইতে থাকে কেন? কেন আমাদের এ সমাজে, এ অদ্ভুত উটের দেশে মানুষের দাম এতো কম? পরিধেয় কেন ঠিক করে একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের আচরন?

জীবনে প্রশ্নবোধকের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়িতেছে।

মনে করিয়াছিলাম এ খটমটে পাতায় কেবলই রামগরুড় এর সহাস্য কথন থাকিবে। তা আর হইলো কই। এমনিতে কিন্তু আমি হাস্যকর একজন মানুষ। কেনো যেন মনে হয় ঠিকঠাক বড় হইয়া উঠিতে পারি নাই। সেই ছোট্টটিই রহিয়া গেছি।ইংরাজিতে তোমরা যাহাকে বলো 'Adult' বা 'Grown up' তাহা হইতে পারিলাম কই?  চিন্তা সাবালক নহে তাই আচরনও জলের মতো। নির্দিষ্ট আকার নাই।  ব্যক্তিত্ব, আত্মসন্মান, সামাজিকতা, ভদ্রতা এ সমস্ত শব্দের অর্থ এখনো মর্মে  প্রবেশ করে নাই। তাই এখনো কতকটা খাপছাড়া, উল্টো কাছিমের মতো জীবনের আকাশ দেখিয়া বিস্মিত হই। দিগন্তের গায়ে অংশুমালীর যে কিরণ মেঘে মিশিয়া নানা রঙ ফুটাইয়া তুলে তাহা ছানিতে চাই। গগের গমখেতে চুপচাপ ঘুরিতে চাই।

চাহিদার তালিকায় দামী পাদুকাজোড়া ক্রমশ নিন্মগামী হয়।আমার দোষ নাই।

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০১৫

একটা গল্পের গল্প



গল্পটার তখনো অনেকটা বাকি,
আমরা দুজন চুপচাপ, মুখোমুখি,
ফ্রিজ শটে স্থির।
 ইতস্তত হেলে যাওয়া জানালা
উড়ে যাচ্ছিল, কাকের ডানায়,
উল্টো কাছিমের বালুকাবেলায়।

শুরুটা হলো ছোটগল্পের মতোন,
অবাস্তব সব উপমার ছড়াছড়ি।
আমি মন দিচ্ছি তোমায়,
তুমি উপমায়।

একের পর এক শব্দ কুড়িয়ে
আমাদের গল্প এগোয়।
কথাগুলো ধোঁয়াশার মতো
আস্তে আস্তে জমে উঠে কুয়াশায়।

আনমনে তুষারপাত  কিছুতেই হয় না।
এ দেশে এখনো বৃষ্টি, কালো মেঘ,
সাদা আলোর আচমকা ঝলক,
অন্ধ জাহাজীর অনন্ত অপেক্ষা।

আমাদের স্বপ্নে একটাই তুষারঝড়।
সে জন্য আমরা অপেক্ষা করি
গোটা একটা জীবন।

গল্পের মধ্যমায় পৌঁছে আমরা টের পাই
এখন,অশীল অন্যমনস্কতা আমাদের
এক করে রাখে।
মৃতবৎ সংলাপ সব ঘিরে ধরে বাহুপাশ,
আমরা নির্বাক হই।

গল্প শেষ করার ইচ্ছে আর হয় না।
আমরা ক্রমাগত বাসি হয়ে যাই।
আমাদের শব্দে ভাসে
মাংসপচা গন্ধ।

অথচ  তোমার শব্দগুলো, অজস্র তারা ছিলো
যাদের পথক্লান্ত আলো, মাত্র এলো।
গ্রহ আর গ্রহান্তরের অগ্রন্থিত কাব্য ছিলো
যাদের দূরত্ব, সমস্ত কবিতার ছন্দ
অথচ আমাদের ছিলো অবাক ধুমকেতু প্রেম,
যে বারবার ফিরে আসে
প্রথম কিশোরীর মুখের মতোন।

শেষমেষ আমরাই নষ্ট করে দিলাম সব
আমাদের চারপাশে অগুনতি অনূভুতির শব।
এখন আমাদের অনেক নষ্ট দিয়ে,
অকালমৃত পুতুলের বিয়ে।

অবান্তর কিছু  আওয়াজ
ঘিরে থাকে চারপাশ।

রক্তের রঙ ফিকে হয়ে গেলে
যে প্রদোষে ফুটেছে কদম,
তার মতো মরে যেতে যেতে
আমরা ভালোবাসি। 

মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

ছাইপাঁশে আঁকা ছবি

মন ভালো না লাগা ব্যাধিবিশেষ না হলেও ব্যাধবিশেষ তো অবশ্যই। এ সময়গুলোতে মনের সমস্ত বিষয় একমতভাবে থাকে না। নিজের সাথে নিজের কেমন যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মনের খারাপ এক অংশ খুবলে খায় অন্য অংশগুলোকে। নিজের ভেতরে জারি হয় সামরিক শাসন। একনায়কের মতো 'মন খারাপ মন' শরীর আর মনকে যেদিকে খুশি টেনে নিয়ে যায়। মনের ভেতর কামানের আওয়াজের মতো অনেকের কণ্ঠস্বরের বিহ্বলতা নিজেকে গ্রাস করতে থাকে। ফেলে আসা যায়গাগুলো ট্যাঙ্কের চাকার মতো মনের জমিনে দাগ কাটতে শুরু করে। সদ্যজাত পাখির অশক্ত ডানার মতো মনে হয় নিজেকে।

সারাদিন সারারাত আছন্নতায় কাটে। আবার আরেকটা সকাল শুরু ঠিক কখন হয়ে গেলো বুঝতে পারা যায় না। মনের অলিতে গলিতে যেন মূর্ছনার আসর বসে। ফাঁপা মগজের কোথাও ক্রমাগত রবীশংকরের সেতারের সাথে ম্যানহুইনের বেহালার সুতীব্র সঙ্গত। এ পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হয়। মানুষ ছাড়া আর সব ভালো লাগে। মানুষদেরকেই কেবল বীভৎস মনে হয়।

মনের আকাশে ছাইরাঙ্গা মেঘ ঢেকে দিয়ে যায় অতীত। নিজেকে আর কিছুতেই চিনতে পারা যায় না। অতীতের পথে ঘন কুয়াশা। নিজেকে দেখা যায় না। কেমন করে সে মানুষটা জন্মে গেলো? কবে ? কবে নিজেকে আলাদা বলে চিনেছে? কতোটা পথ হেঁটে নিজেকে জেনেছে? নাকি কিচ্ছু জানে না এখনো? সে এতো তীব্র নিঃসঙ্গতার বিষে মাতাল কেন? সংঘ ও সঙ্গ এতো অসহ্য মনে হয় কেন?

অতীত প্রাসাদের বহু স্মৃতি কামরায় নিজের লাগানো তালা। চাবি কোথায় হারিয়েছে সেটাও মনে করতে বাধে। মাঝে
মাঝে নিজের ভেতরকার দানবের সাথে কথা হয়। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরের মানুষের সাথে। বন্ধ দরজার ওপারে দাড়িয়ে নিজের দানব আর নিজের মানুষগুলোকে নেড়ে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু দরজাগুলো খোলার সাহস আর হয় না।

অনেক সময় কিসব অবাক অনুভূতির টুকরো এসে আঘাত করে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য নিজেকে ছোয়া যায়। সেই অনুভূতিগুলোই কি আমার অবচেতনের পাঠানো চিঠি কিনা তা আমি জানি না। আর পাঠালেও সে চিঠি কখনো খুলে দেখিনি।

জীবনটাকে নিয়ে কি করা উচিত সেটা কখনোই বুঝতে পারি না, পারবো বলেও মনে হয় না। নিজের ভেতরকার তীব্র মানুষটি, যার সাথে আমার তুমুল সহবাস আদি-অন্ত, তাকে কখোনো ছুঁয়ে দেখা গেলো না। বুঝতে পারা গেলো না।

বাইরের এই খোলসের ভেতরে পোরা অস্তিত্বকে খুঁজে দেখাটা খুব দরকার। সে আসলে কি চায়? কোন প্রশ্নের উত্তর চাই তার? কোন প্রশ্নগুলো সে করতে যায় জগতের উত্তরের প্রতি?
জানাটা ভীষন দরকার, অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

 অন্যকে জানানোর নিজেকে চেনানোর চেয়ে নিজেকে চেনা-জানাটাই ক্রমশ জরুরী হয়ে উঠছে। ভালো লাগা না লাগার যুগলবন্দীর এ অপার্থিব জীবন কেন তার উত্তরের কিয়দাংশের কিছুটা জানা গেলেও বেশ হতো।


দেখানোর আসলে কিছু নেই। নেই আরোপিত উদাসীনতার কোন মানে। নিজের মনের ঝড়ের নবম সংকেত
আসলে কারো বন্দরেই পৌঁছোয় না। নিজের দুঃখের ঢেউগুলো চিরে ফেলে নিজেকেই এগুতে হয়। একাই অশক্ত হাতে ধরতে হয় শক্ত হাল। ঝড়ের পর ঝড় পেড়িয়ে একা অভিশপ্ত  জাহাজীর মতো টেনে নেয়া জীবন। একাই শেষ করতে চাই সব।লগবুকে কিচ্ছু থাকবে না। অজস্র গল্প জমা বুক নিয়ে চুপচাপ বন্দরে পৌঁছুবো একদিন।কাওকে কিছু না বলে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেব। কেও না জানলো আমার গল্প। সাগরের পাড়ে চুপ করে বসে দেখবো কতোটা পেরিয়ে এলাম। কি অদ্ভূতুড়ে ছিলো আমার নেশাতুর একাকীত্বের জীবন। শেষমেষ একদিন সাগরের বুকে ঝরে পড়া অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটার একটার মতো ঝরে যাবো এই পার্থিব জগতের অপার্থিবতার মেঘের বুক থেকে। ভেসে বেড়ানোর খেলা শেষে অকিঞ্চিৎকর জীবন শেষ হয়ে মিশে যাবে থমকে থেকেও উত্তাল জীবনের মহাসমুদ্রের জলে।

শনিবার, ১৬ মে, ২০১৫

যাপিত জীবন আর সিগারেটচরিত

ক্যান্টিনের সামনের কামিনী গাছটা এলোচুলো চঞ্চল কিশোরীর মতো কাল সারারাত বড্ড ভিজেছে।সারা রাত বর্ষণ শেষের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এখন ঝাঁকড়া পাতার চুল থেকে টুপটাপ জল ঝেড়ে ফেলছে।সারা রাত ঝরে যাওয়া আকাশ যেন এই অদ্ভুত জীবন্ত গ্রহের উপর মটকা মেরে পরে আছে।আকাশের গায়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন এক ধরনের নরম সাদা রঙ। 

আমার একহাতে একখানা উষ্ণ চায়ের কাপ। আরেক হাতে দিনের প্রথম সিগারেট। চারপাশের সমস্ত গাছের পাতা টিয়ার পালকের সজীবতার ভেজা সবুজ। শিবরঞ্জনীর কোমল গান্ধারের মতো বিষন্ন সুন্দর সকাল।  

ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর খেয়াল করলাম বৃষ্টি শেষের আরামদায়ক ঠান্ডা। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোটাই বোধহয় স্বাভাবিক কাজ ছিলো। কিন্তু কেন যেন উঠেই পড়লাম।ইলেক্ট্রিসিটি আছে, ভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণত, এ শহরে ঝড় বৃষ্টির আগে অবশ্যম্ভাবীভাবে বিদ্যুৎ হাওয়া হয়ে যায়, আর আকাশ ঝলমলে সুন্দর হওয়ার আগে আর ফেরত আসে না।

হাত মুখ ধুয়ে এসে ইলেক্ট্রিক কেটলীটায় জল চাপালাম।গতরাতে পড়ার চেষ্টা করা বইগুলো বিছানা থেকে বুকশেলফের উপর রেখে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতাটা বের করে বারান্দায়। স্বপ্নের তাড়া খাওয়া একা বিষন্ন এ মানুষটা এ ভাষার অন্যতম প্রধান কবি হয়েও বৃষ্টি নিয়ে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখেন নি।কিন্তু তবুও কি অবাস্তব সুন্দর সব উপমা।
ভোর,
আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল

চা বানিয়ে কম্পিউটারটা চালু করলাম।সঙ্গীত শূন্য বিষন্ন সময় পার করার মানে নেই।ভোর আর গভীর রাত যন্ত্রসঙ্গীতের, ভোরে উঠে মানুষের কন্ঠ শুনতে ভালো লাগে না।Ricky King এর গিটার আর Brian Crain এর পিয়ানোর  ট্র্যাকগুলো ছেড়ে লো ভলিউমে চুপচাপ শুনছি। রুমমেটরা সব ঘুমাচ্ছে। ঘর ভরতি হয়ে উঠছে গিটার আর পিয়ানোর কোমল আওয়াজে । King এর Don’t cry for me Argentina শুনতে শুনতে মনে হলো বাইরে গেলে হয়, ঘুরে আসা যাক।

হলের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছদুটো দাড়ানো আসর শেষের যুগল নর্তকীর মতো। বৃষ্টিতে ভিজে ছোপ ছোপ বাদামী বাকলের শরীর। মাথায় চিরোল চিরোল সবুজ পাতা আর আগুনে কমলা থোপা থোপা ফুল।তরল প্রকৃতির পরিচ্ছন্ন বাতাস ঘুরে ঘুরে ছুয়ে দিচ্ছে। মন ভালো হয়ে গেলো।

নাস্তা সেরে চা হাতে ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।কামিনী গাছটার দিকে তাকিয়ে  সিগারেটটা ধরাতেই গতকাল পড়া শুক্রবারের থিওরি মনে পড়লো। আপন মনে হাসলাম। তারপর সিগারেটের ঠোঁটে আরেকটা লম্বা চুমু দিয়ে আরেকটু বিষ খেলাম।


তরুণীর ঠোঁটে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ না হলে সিগারেটের ঠোঁটে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ হবে কেন?দুটোই তো সমান পোড়ায় আর জ্বালায়।সিগারেট তবু ভালো, নিজের ইচ্ছেয় জ্বালানো পোড়ানো যায়। মাইথোলজিতে পড়া কিউপিডের বর্ণনা মাথায় আবৃতি হলো।আগুনের উপহার দেয়া দেবশিশুর চেহারার চতুর সে দেবতা...

“He is cruel in his play,
Small are his hands yet his arrows fly far as death.
Tiny his shaft, but it carries heaven high.
Touch not his treacherous gifts, they are dipped in fire”

কিউপিডের দেয়া বিশ্বাসঘাতক উপহার প্রেম আর ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দেয়া ঘাতক উপহার সিগারেট এ দুটোর মধ্যে কি মিল! দুটোই আগুনে চোবানো ভয়ংকর সুন্দর।বুক পুড়ে যাবে জেনেও জড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা।একটা ঘাতক, অন্যটা বিশ্বাসঘাতক।

সিগারেট খাবার আসলে কোন যুক্তি নেই। ‘Smoking Kills’ এ সাবধানবানী পড়ার পরেও কেন মানুষ সিগারেট খায় তা অধীশ্বর জানেন। যারা খায় তারা লোক বিশেষ ভালো না তা বলতে গেলে ইতিহাস ঠেঙ্গাতে আসবে।পাইপ-চুরুট-সিগারেট ফোঁকা মহাপুরুষ তো আর কম নেই।( উল্টপীঠও আছে, ধূমপায়ী বদমাশও প্রচুর! আয়নায় তাকালে একটাকে দেখি।)

সিগারেটের রোমান্টিসিজমের শুরু আসলে কোথায় কে জানে? আমার নিজেরটা বলছি।

ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় কমিউনিজম নিয়ে অল্পবিস্তর পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। তো যে বীজে যে ফল। নিউমার্কেট থেকে আমার তখনকার হিরো চে গেভারার একখানা পোস্টার কিনে নিয়ে এলাম। দরজায় টানিয়ে প্রায়ই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। ছবিটা এরকম, বিপ্লবী কাওকে কোন একটা নির্দেশ দিচ্ছেন হাত নেড়ে। তার বা হাতের মধ্যমা আর আঙ্গুরীর মাঝে একটা জ্বলন্ত চুরুট।উদাসী হালকা দাঁড়ির মুখে ঠোটের কোনায় বিদ্রুপের হাসি।
বালক আর কি করে! বালক রেড মারলবোরো কিনে ধরায়।অতঃপর শুরু।   

রাজীব বিশ্বাসের লেখার এত তত্ত্ব আর তথ্য ভালো না লাগলেও একটা কথা আসলেই সত্যি। সিগারেট একবার ধরলে পুরোপুরি ছাড়া কঠিন, প্রায় অসম্ভব কাজ। মার্ক টোয়েন এর মতো অবস্থা হয়ে যাবে।  

আসলে সিগারেট হলো কৈশোরের প্রথম প্রেমিকার মতো।দুঃখ কষ্ট পেলেই যার মুখ মনে পড়ে।তাই মাঝরাতে একা লাগলে বারবার তার ঠোঁটে ফিরে আসার খেলা। ধরা আর ছাড়ার এই খেলা খেলতে খেলতে জীবন পার হয়ে যাবে।

এজন্য, নিশ্চিত ঘাতক বেছে না নিয়ে বিশ্বাসের জুয়া খেলুন বরং, ভাগ্যে থাকলে সহস্র বছরের সাধনার ধন, একটি হৃদয় এক লহমায় পেয়ে যাবেন। আর কিছু পাগল ছাগল থাকবেই, যারা খেলব না বলে উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাবে।এরা বাতিল, এদের কথা বাদ দিন। 



 

   







শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

স্বপ্নকল্পের বাস্তবতা

মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। না জেগে থেকে অসাধারন কোন বাস্তব ভবিষ্যৎ কল্পনার কথা বলছি না। বাস্তব আর অবাস্তবের মিশেলে ঘুমের মাঝে দেখা অদ্ভুত জগত এর কথা বলছি। তবে স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ অন্য পশুদের থেকে আলাদা এমনটা না। প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ীই যে স্বপ্ন দেখে এটা এখন প্রমানিত। কিন্তু তারা বোধকরি মানুষদের মতো ঘুম থেকে উঠে একে অন্যকে বলে না  '' বড়ো আচানক খোয়াব দেখছি আইজ। হইলো কি..."  আসলে আমরা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করতে ভালোবাসি। বাজারে খোয়াবনামা বইটি এখনো বেশ বিক্রি হয় বলে জানি। তবে সে গাঁজাখুরি মেনে নিতে বাধে।আসলে মেনে নিতে কখনোই ভালোবাসিনি, সব কিছুই মেনে নেয়ার বদলে মনেই নিতে চাই।

স্বপ্ন জিনিসটা আসলে আমাদের মস্তিষ্কের একটা খেলা। আমাদের অস্তিত্বের সাথে খেলতে সে খুব ভালোবাসে বলেই স্বপ্ন দ্যাখে। সে খেলার কিছু অংশ আটপৌরে, কিছুটা সম্পূর্ণ মৌলিক, আর কিছুটা ব্যাখ্যাতীত। স্বপ্ন একটা মজা, অদ্ভুতুড়ে বিষয়। মৌলিক আর ব্যাখ্যাতীত অংশগুলো মানুষকে ভাবিয়েছে আর ভাবাচ্ছে এখনো।

এমনকি এর  আটপৌরে অংশটাও কম মজার নয় ।

ধরা যাক কেও স্বপ্ন দেখছেন নিজের গায়ে আগুন লেগে যাবার। প্রচন্ড উত্তাপ তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে ব্যাপারটা বাস্তবে হয়তো তার শরীরের কোন অংশ বা গোটা শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়ে গেছে সামান্য ।তাই এই 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো' টাইপ বিরোধীদলীয় স্বপ্ন । আমাদের দেশের গরমের দিন রাতে লোডশেডিং এর ভালো উদাহরন। এক্ষেত্রে  ঘুমিয়ে থাকা বাছাধনরা যে প্রতিনিয়ত অগ্নুৎপাত দেখে না তা তাদের সৌভাগ্য ।

আরেকটা স্বপ্নাংশ অনেকে প্রায়ই দেখেন, যেকোন স্বপ্নের  কোন এক পর্যায়ে কোন উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যেতে থাকেন বা তলিয়ে যাবার মতো অনুভূতি ঘিরে ধরে তাদের। না ভয় নেই, আপনার বিছানা হুট করে রেলিং ছাড়া ছাদ হয়ে যায় নি। আর মহাসমুদ্রের লোনা পানি ছোটোবেলায় অনেকে বিছানায় ঢাললেও  আপাতত বিছানা অতল জলাধার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। এর অতি বাস্তব ব্যাখ্যা হলো মাথা বালিশ থকে পড়ে উচ্চতার তারতম্য হলে এ ধরনের স্বপ্নাংশ এসে অদ্ভুত স্বপ্নের জগতকে আরও একটু আবছা করে দেয়।

অনেক স্বপ্ন আমরা টের পাই না। বলা হয় অধিকাংশ স্বপ্নের গতি এতো দ্রুত যে আমাদের অস্তিত্ব এর নাগাল পায় না। ওগুলো চলচ্চিত্রের দ্রুত টানা ছবির মতো আমাদের মগজে ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে যায়। গভীর ঘুমের স্বপ্নই আমরা কেবল মনে রাখি। বিশাল কোন স্বপ্ন যাতে অনেক চরিত্র আর অনেক ঘটনার সন্নিবেশ থাকে তা আমরা কয়েক সেকেন্ডে দেখে ফেলি। সময় স্বপ্নের জগতে আপেক্ষিক ,অনেক ধীর। টাইম ডাইলুশনের এ আপাত অত্যাধুনিক তত্ত্ব কিন্তু অতি প্রাচীন।

বাস্তবতা আর স্বপ্নের সীমারেখা কোথায় তা আসলে বলা যায় না। এমনকি আপনার এতো সাধের জীবনও একটা দীর্ঘ স্বপ্ন যে না তার প্রমান কি? অনেকের মাথায় ম্যাট্রিক্স সিনেমার কথা চলে আসবে জানি বা এলিস ইন দ্য ওন্ডারল্যান্ড। কিন্তু বাস্তব আর স্বপ্নের পার্থক্য নিয়ে মানুষের চিন্তা কতো প্রাচীন তা জানলে আসলে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হয়। আর মজার ব্যাপার এই Reality বা বাস্তবের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের শুরু আমাদের ভারতবর্ষেই ।

গল্পটা মহাভারতের।
এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ স্নান করতে গিয়েছেন দিঘিতে। মাথায় নানা সংসারচিন্তা, দ্রুত স্নান শেষ করে বাড়ী ফিরবেন তাই ইচ্ছা। দিঘিতে নেমে ডুব দিলেন। আবার জলের উপর মাথা তুলতেই দেখলেন এক পরমা সুন্দরী সালংকারা রমনী্র প্রতিবিম্ব দিঘির জলে। আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে না পেয়ে নিজের দিকে তাকাতেই ব্রাহ্মণ হতভম্ব। তিনিই তো ওই রমনী। তার পরনে বহুমূল্য শাড়ী, গায়ে অলংকার । পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। সে অদ্ভুত দেশের অকৃতদার  রাজা সে দিঘির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে রমনীকে দেখেই তার রানী করে নিতে চাইলেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়েও গেলো। সে দেশে রমনীরুপী ব্রাহ্মণ এর সুখের সংসার হলো। পুত্র, কন্যা, রাজ্যপাট সবই তার। অতঃপর একদিন, এই রানী এক দুপুরে স্নান করতে নেমেছেন জলে। ডুব দিয়ে উঠতেই খেয়াল করলেন জলে এক বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে। এক ডুবে এক জীবন পার করলেন ব্রাহ্মণ । কয়েক মুহূর্ত পার হয়েছে এপারের বাস্তবতায়। ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে গেলেন। কিন্তু তার মন কেমন করছিলো ওপারের বাস্তবতার সন্তানদের জন্য। এপারের বাস্তবতা ওপারের স্বপ্ন। কোনটা বেশি বাস্তব?

এ অতি প্রাচীন গল্পে কি কি জিনিস এসেছে খেয়াল করলে অবাক লাগে।  টাউম ডাইলুশন, প্যারালাল ইউনিভার্স এর মতো থিওরি কিন্তু এ গল্পে আশ্রয় নিয়েছে খুব সহজে।

 স্বপ্নে আমাদের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির ব্যবহার ও বেশ চমকপ্রদ। আমরা চেতন অবস্থায় যে অতি সামান্য গুরুত্বহীন  জিনিসগুলো ভুলে যাই স্বপ্নে আমাদের মন সেগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেয়। স্বপ্নে আমাদের যে অবস্থাটা হয় তাকে সাইকোলজির গুরুদেব ফ্রয়েড বলতেন 'Hypermnesic  State' অর্থাৎ আমাদের স্মৃতি অতি প্রখর হয়ে ওঠে। অতি খুটিনাটি আমরা অতি সহজে মনে করতে পারি যা চেতন অবস্থায় আমরা কিছুতেই মনে রাখতে চেষ্টা করি না, চেষ্টা করলেও পারবো না। অনেকেই ভাবছে ওঁ মধু ! তাহলে স্বপ্নে পরীক্ষা দিতে পারলে কি ভালই না হতো। দুঃখের কথা আমাদের মন আমাদের মতো এতো বেরসিক না যে বিদঘুটে ল্যাটিন নাম মনে করবে। বরং স্বপ্ন আমাদের মনে করায় অকিঞ্চিৎকর ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো । স্বপ্নে আমরা ছোট ছোট ঘটনা আর জিনিসের সম্মেলন দেখি। বহু আগে দেখা কোন রমনীর গ্রীবার সৌন্দর্য, রাস্তা দিয়ে চলা আইসক্রিমওয়ালার চেহারা, ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়া মায়ের শাড়ি।

স্বপ্নে মেরেলিন মনরোর গালের তিল বা শারলিজ থেরনের জড়ানো বহুবোধক মুখভঙ্গি ফার্মাকোলজির স্যার কি বলেছিলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । স্বপ্নে সেটাই বারবার আসবে তাই স্বাভাবিক।(এটা ব্যক্তিগত!)

আর স্বপ্নই বোধকরি আমাদের শৈশবে ফেরাতে পারে। অনেকেই আছেন স্বপ্নে কিছু জায়গা বা মানুষ দেখেন। তাদের মনে হয় সে জায়গায় তারা কখনো যান নি, সে মানুষদের তারা চেনেন না। মজার ব্যাপার স্বপ্ন আমাদের অতি প্রাচীন ভুলে যাওয়া স্মৃতি তুলে আনে মনের গহীন থেকে। আসলে সে জায়গাগুলো বা মানুষরা সদূর শৈশবের স্মৃতিতে আছে। আমাদের চেতন মন যাদের বহু আগে ভুলে গেছে। স্বপ্নে মানুষ শিশুর মতো সরল হয়ে ওঠে । তার উইশফুল থিঙ্কিংগুলো তার দমিত ইচ্ছে যা চেতনার যুক্তিতে সে আবদ্ধ করেছে, সেগুলো আকাশে উড়ে যেতে চায়। স্বপ্নে মানুষ তার ইচ্ছেপূরন করে। সেক্ষেত্রে বলতে হয় আমরা শিশুর মতো স্বপ্ন দেখি। যুক্তির গাঁথুনিতে নয়, স্বপ্ন দাঁড়িয়ে থাকে আবেগ আর ইচ্ছের বালুচরে।

স্বপ্নের কিছু মৌলিক দিক আছে যা প্রতিটা মানুষের জন্য আলাদা। অনেক সময় একি জায়গা বা একি মানুষ আমরা স্বপ্নে বারবার দেখি। সেগুলো আসলে এক ধরনের প্রতীক। আমাদের অচেতন মন অবচেতনের জানলায় চেতনার সাথে কথা বলতে চায় সেসব প্রতীকে। অধিকাংশ সময়ে আমরা তা ধরতে পারি না। প্রতিটা মানুষের অস্তিত্বের গভীরে অসংখ্য বন্ধ দরজা থাকে। সে বন্ধ দরজার ওপারে অন্ধকার খেলা করে। আমাদের আপন আধার। সেসব অন্ধকার সত্যকে আমরা নিজেরাই সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। শৈশবের ভয়, আতংকের স্মৃতি, মর্মন্তুদ কষ্ট আমরা লুকিয়ে রাখি সেসব স্মৃতির ঘরে। স্বপ্নে আমাদের যুক্তির বেড়াভাঙ্গা শিশু সেসব অন্ধকার ঘরের দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিয়ে নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পায়। সে ভয় প্রতিটা মানুষের জন্য মৌলিক। অতি সামান্য কিছু জিনিসে অবচেতন মনে যে ঝড় শুরু হয় তার ধাক্কা লাগে আমাদের চেতনায়। আমরা অবাক হই।

আর শেষমেশ বলতে হয় স্বপ্নের ব্যাখ্যাতীত দিকটার কথা । ফ্রয়েড এর ভাবশিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইউং তার স্বপ্ন নিয়ে করা অনেক কাজ প্রকাশ করেন নি। সাইকোলজির এই জায়ান্টও কিছুতেই অনেক স্বপ্নের অতি আশ্চর্য দিক ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেন নি। অবচেতন মনের এই রাশিয়ান রুলেতের রহস্যে হেরে যেতে হয়েছে সমস্ত বাস্তবতার ব্যাখ্যাকে। কিছু স্বপ্ন মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে, যুক্তির অধিক।

স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভালোলাগার মূল কারন স্বপ্ন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কতো ঠুনকো এক জগতে বাস করি। বিভূতিভূষণের মতো আমারো মনে হয় যে দৃশ্যমান জগতের ভেতরে কোথাও আরও জগত আছে।এপারের পর্দার  আপাতবাস্তবতা ছিড়ে ফেললেই যেন ওপারের নাটক আমাদের চোখে আসবে। আর স্বপ্ন আমাদের বোঝায় মানুষ প্রানী হিসেবে কতোটা পরিণত আর অদ্ভুত।  স্বপ্নে দেখা যায় আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা। তার নিউরনে নিউরনে কতো কিছু লুকিয়ে রাখা আছে সযত্নে। মস্তিষ্ক কিছুই হারায় না। আমাদের চেতন মন হয়তো সমস্ত কিছুর নাগাল পায় না । কিন্তু স্বপ্নবাজ অবচেতন সবকিছু খেয়াল করে আর মনেও রাখে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের The  Interpretation of Dreams বইয়ের একটা কথা দিয়েই শেষ করছিঃ

" Nothing that our minds once possessed can ever be lost"

চাইলেও আমরা সত্যিকারভাবে  কিছু ভুলে যেতে পারি না, সেটা সম্ভব না। তা সে কোন অতি গুরুত্ববহ কোন মানুষই হোক বা তুচ্ছ কোন বস্তু।  কারন আমরা স্বপ্ন দেখি।

তথ্যসূত্রঃ
1.The Interpretation of Dreams- Sigmund Freud
2.MIT Research News
3. A general Introduction to Psychoanalysis- Sigmund Freud










শুক্রবার, ১ মে, ২০১৫

তারুণ্য আর বলিরেখার গল্প

''ছেলে তো থাকে না বাবা, একলাই থাকি। আমি আর আমার এই দুই নাতি নাতনী।"
নীচু গলায় বলা কথাটা রঙ উঠা ক্ষয়া সোনালী ফ্রেমের চশমা পড়া জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত লুতফুন্নাহার বেগমের। কথা হচ্ছিলো তার বাড়ির উঠোনে বসে।

আবাসিক মাঠ পর্যায় প্রশিক্ষন। মেডিকেলের দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষার কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ের একটা অংশ, এক ধরনের জরিপকাজ। আমাদের জরিপের বিষয়বস্তু ছিলো নদীভাঙ্গন এলাকার বয়োবৃদ্ধ মানুষদের অবস্থা । জরিপ এলাকা চর ভদ্রাসন বেশ বর্ধিষ্ণু । গ্রামীন আবেশে শহুরে সুবিধার চিহ্ন চারিদিকে। জলরং ছবির সবুজ প্রকৃতির  মাঝে মাঝে বাড়ি ঘরের ইট কাঠের ধূসরতার ছোপ। বাসটা আমাদের রাস্তার মোড়ে বিশাল এক রেন্ট্রি গাছের নিচে নামিয়ে দিয়ে সামনে চলে গেল এক এক করে বাকি সবাইকে সুবিধামতো যায়গায় পৌঁছে দিতে।আমরা বলতে আমার তিন সহপাঠী, দুই সহপাঠিনী আর আমি। 

বৈশাখের মাঝামাঝির দুপুর। রোদের তীব্রতা থাকলেও গাছপালা থাকায় গরম অতটা অসহনীয় হয়ে উঠে নি আর এই ছোট্ট দলটাও বেশ মনমতোই হয়েছে। নামের শেষে বাদশা টাইটেল থাকায় কিনা জানি না, সহপাঠী সাগর , বাদশার মতোই অতি দ্রুত অবস্থার নিয়ন্ত্রন নিয়ে তার সৈন্য সামন্ত দিয়ে আজকের যুদ্ধ (জরিপ!) শুরু করে দিতে চাইলো। এক্ষেত্রে তার সৈন্য সামন্ত সাকুল্যে ছয়। সৈন্যদলে আছে বীর চট্টলার ব্যাকব্রাশ করা স্মার্ট গোছানো বীর, আতিক। কম্পিউটার থেকে দূরে থাকায় অনলাইন গেম 'লল' খেলতে না পেরে বিরহকাতর ব্রজ। আপাদমস্তক শোকের কালো পোষাক শরীরে ধারন করেও অতি উৎফুল্ল শরমী।ফমেক ইতিহাস কুখ্যাত অলস হলেও সুখ্যাত গিটারিস্ট, ইকবাল। বোরখায় শুধু চোখদুটি বের করা নিনজা কন্যা মরিয়ম। আর সবশেষ, ঊন মানুষ অভাজন আমি।

পীচ রাস্তা ধরে গ্রামের ভেতরের দিকে হাটা ধরলাম সবাই। চারপাশে কেমন গ্রাম গ্রাম সোদাগন্ধ। এদিক ওদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মাথায় থোকা থোকা আগুন রং এর ফুল ফুটেছে।কড়া রং ফুলগুলো সাদা মেঘের দাগ লাগানো হালকা নীল আকাশের পটভূমিতে যেন চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বারবার দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায়। গ্রীষ্ম তো ফলের সময়, আম কাঁঠাল গাছগুলোতে কাঁচা ফল পাকবার অপেক্ষায় রোদ পোহাচ্ছে। লিচু গাছগুলোয় সবে ফলের আগমনী বাজছে ছোট ছোট থোকায়। সফেদা আতা আরও কত গাছ গ্রামের বাড়িগুলোর উঠোনে আর পথের ধারে। ফল গাছ ছাড়াও শাল আর মেহগনিগুলো সদম্ভে মাথা উচু করে ছায়া দিচ্ছে এখানে ওখানে। পথের ধারে ঘাসের উপর কি একটা বেগুণী রঙ এর ঘাসফুল ফুটে আছে জোড়ায় জোড়ায়, নাম জানি না। রবীন্দ্রনাথ হলে নিজেই বোধকরি নাম দিয়ে দিতেন 'বাগানবিলাস' এর এর মতো...   'যুগল ফুল' । গ্রামের জমিতে খুব একটা চাষ আর এখন হয় না বোঝা যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা পতিত জমিতে বুনোঘাসের শীষ মাথা তুলেছে। দূর থেকে দেখলে সদ্য জাগা কাশফুল বলে ভুল হয়।

একে অন্যকে সাহস দিয়ে প্রথম বাড়িটার সামনে গেলাম। বাড়ির সীমানা বেড়া আর দরজা টিনের, গেটের পাশে টিনটায় ফাটল ধরেছে। ভেতরে তাকাতেই শ্যাওলামাখা চওড়া উঠোন চোখে পড়লো। যাই হোক, অস্বস্তি ভেঙ্গে দরজায় টোকা দিলাম আমরা। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। পরিচয় দেবার পর বাড়িতে বয়স্ক কেও আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে জানা গেল দুজন আছেন।

 মহিলা আমাদের পথ দেখিয়ে তাদের ঘরটায় নিয়ে গেলেন। টিনের দোচালা ঘর,মাটির মেঝে। ঘরে ঢুকতেই যেটা চোখে পড়লো সেটা বিশাল একটা বিছানা। দুটো বড় চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে বোঝা গেলো। বিছানার ধারেই বসে আছেন এক অতশীপর দম্পতি। বৃদ্ধ বিছানার পাশের টেবিলে রাখা প্লেট থেকে কিছু একটা খাচ্ছেন আর বৃদ্ধা বসে আছেন চুপচাপ। এ বৃদ্ধার একটা ব্যাপার বেশ মজার লাগলো। তার চোখে হালফ্যাশনের রোদচশমা । চোখে ছানীর অপরেশন হয়েছে তাই পরে আছেন।পাকা ডালিমরাঙ্গা বৃদ্ধাকে বেশ লাগছে কালো রোদচশমায়। আর বৃদ্ধ বেশ সপ্রতিভ, আমাদের বসতে চেয়ার দিতে হুকুম করে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন।যৌবনে শক্তি ধরতেন বোঝা যায়। জানা গেলো কোন এক চরে চেয়ারম্যান ছিলেন পয়ত্রিশ বছর।
 কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের হাতে হাতে জরিপের কাগজ, কিন্তু দেখা গেলো পেনসিলে কাজ করতে হবে। যথারীতি ছেলেরা কেউই পেন্সিলের ভার বয়ে আনতে পারে নি, দুই মহিয়সীই ভরসা। প্রশ্নপর্ব  শুরু হলো। দুজনই বেশ মজা পাচ্ছিলেন। একটা বয়সের পর মানুষের কেবলই মনে হতে থাকে তাকে ঠিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তারা সে বয়স পার করে আসা মানুষ হওয়ায়, ক্ষনিকের পাওয়া এ গুরুত্ব তারা বেশ উপভোগ করছেন বোঝা গেল।

আস্তে আস্তে ইনহিবিশন কেটে গেল। বলা চলে তখন মুক্ত বিহঙ্গের দলের মতো  এ বাড়ি ও বাড়িতে হামলা চালালো বাদশা সাগরের সৈন্যরা । না, নজরানার সোনাদানার খোঁজে না, দু একজন বলিরেখা পড়া মানুষের খোঁজে। বহু মানুষের কারিগর রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার, জীবনের কর্মক্লান্ত শেষ বয়সের কৃষাণ কৃষাণী, টাকা পয়সা বাদ দিয়ে এখন পাপ পুণ্যের হিসেবে ব্যস্ত  অবসরে যাওয়া ব্যবসায়ী, সেই কৈশর থেকে জীবনের শেষভাগে এসেও পরিবার সামলানো গৃহবধূরা, এদের সকলের সাথেই কথা হলো। তাদের বহুদর্শী চোখে অতীত জীবনযুদ্ধের স্পষ্ট ছাপ , তাদের কথায় জীবনের পথ পাড়ি দেবার ক্লান্ত সুর আর ব্যবহারে প্রাচীন বাংলার আতিথীয়তা। সরল মানুষগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর  মতই সবুজাভ কোমলতা এখনো আছে। প্রকৃতির সাথে অবিরত সংগ্রাম করে টিকে থেকে জীবনের শেষ প্রন্তে শান্তি খুঁজে পাওয়া এ বয়োবৃদ্ধদের বড়ো ভালো লাগলো।

এর মধ্যেই দলের লম্বা সদস্যদের লজ্জা দিয়ে লাফিয়ে আম পেড়ে সে আম আবার এক বাড়িতে ঝাললবন দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করে ফেলল শরমী। সে বাড়িতে ও বেশ কিছু আম উপহারও পেলো । বাড়ির মহিলারা তার কাঁচা আম প্রীতি দেখে মুগ্ধ! আমরা মুগ্ধ গ্রামের মানুষের আতিথীয়তায়। দলে পুরুষ সদস্যরা যে আসলে অতি অকর্মণ্য তা এ মহোদয়া স্বল্প সময়ে প্রমান করার চেষ্টা করলেন! শুধুমাত্র বাদশা ভাইই  এক বাড়িতে ছেলেদের ইজ্জত রক্ষার্থে একাই চা- বিস্কুট খেয়ে নিজের ফর্মে চায়ের দাগ ফেলে দিলে কিছুটা মুখরক্ষা হলো আর কি!

ততোক্ষণে দল দুভাগ হয়ে কাজ করছে। আমরা জনাচারেক ঘুরতে ঘুরতে একটা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। বাড়ির বাইরে সার করে লাগানো সুপুরি গাছ। বাইরে একটা রঙ উঠা সাইনবোর্ড । খুব কষ্ট করে পড়তে হয়... সাধনা ঔষুধালয়। বাইরের প্রাচীন দেয়ালটা ইটের, মাঝে মাঝে চান-তারা আঁকা নকশা খেয়াল করে না তাকালে চোখে পড়ে না । ক্ষয়া কাঠের দরজা পেরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।  দরজা বরাবর উঠোন পেরিয়ে একটা রান্নাঘর আর খাবার যায়গা । তার ছায়ায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা।পরনে ম্যাক্সি, মাথায় বড় একটা ওড়না দিয়ে দেওয়া ঘোমটার দুপাশ থেকে শন রাঙা চুল বেরিয়ে আছে।চোখে একটা রঙচটা সোনালী চশমা।প্রথম দর্শনেই আমার কেন যেন মনে হলো যেন মহিলা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কিসের?

 আমরা পরিচয় পর্ব শেষ করতে না করতেই মহিলা ব্যস্ত হয়ে গেলেন আমাদের বসার ব্যবস্থা করার জন্য। তাকে সুস্থির করে আমরা কোনরকমে বসলাম। প্রশ্ন করার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে শরমী লিখছিলো। প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা আবার শুরু হলো...
"আপনার নাম?"
"লুতফুন্নাহার বেগম"
অতঃপর তার গল্প। এক ছেলের জননী এ মহিলা এখন একাই থাকেন। ছেলে দেশের বাইরে। সাথে যাদেরকে নাতি নাতনী বললেন তাদের কেও আশ্রিত আর কেও অল্প সময়ের জন্য তার সাথে আছে বোঝা যাচ্ছিলো। কথা শেষ না হতেই তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেলের শরবৎ এর গ্লাস চলে এলো হাতে হাতে। আর এলো আচার। আচারের বয়াম দেখে বোঝা গেলো অতি যত্নে তুলে রাখা জিনিস। শুধু আম আর মশলা না, মায়ের স্নেহও সে খাবারে মিশে আছে।বারবার মনে হতে লাগলো বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে এ রকম কতো বর্ষীয়সী জননী  অপেক্ষা করে আছেন তার সন্তানের জন্য। বিদেশ বিভূঁই শত পথ পাড়ি দিয়ে কর্ম ক্লান্ত সন্তান ফিরে আসবে মায়ের কোলে শীতল হতে।অপেক্ষা। এই মায়েরাই তো আমাদের গ্রাম আমাদের দেশ। তারা অপেক্ষা করেন শহরের ইটের দেয়াল পেরিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে দেশের সমস্ত সন্তানেরা।

এক বৃদ্ধা জরিপে অংশ নিতে নারাজ, কারন কিছুতেই তার রক্তচাপ মাপতে দেবেন না।  বললেন " আমার পোলা নাই। মাইয়াগুলার বিয়া দিসি এখন এইটা মাপলে যদি অসুখ বাইর হয়। কে দেখবো?"
 সরল প্রশ্নের পেছনে জীবনের অনেক গরল লুকিয়ে আছে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আরেক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন তার যে অপারেশন করাতে হবে তার সাহায্য করার কোন উপায় আমাদের এ আর এফ এস টি থেকে হবে কিনা? তার ছেলেরা দেখে না ।কি বলা উচিত ছিলো কেও বুঝতে পারি নি।

এরা প্রায় সকলেই নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন জীবনের কোন না কোন সময়। কিন্তু দমে যান নি । নদী ভাঙন সংক্রান্ত প্রশ্নে তাদের নির্বিকার সব উত্তর তাদের জীবনের লড়াকু মানসিকতা বারবার টের পাইয়ে দেয়।

কিন্তু সময়ও তো এক না থামা নদী। সে নদীর একপাশে তারা তাদের নিজেদের জীবন ভেঙ্গে  আরেক পাড়ে গড়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে। এখন এ মানুষগুলো সব দিয়ে রিক্ত হয়ে অপেক্ষায় আছেন মৃত্যুর। জরা তার থাবা বসিয়ে দিয়েছে প্রতিটি শরীরে। তারা বড় ক্লান্ত। তবু এখনো তাদের চারপাশে জীবনের তীব্র স্রোত। সন্তান, নাতি নাতনী , নতুন আসা শিশুরা। এক জীবনের শেষ আরেক জীবনের শুরু। ঈশরবুড়োর লেখা এ চক্র গল্পের যে কোন শেষ নেই। গল্প চলবে।













সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

ডাক্তার আছেন? (মুভি স্পয়লার আর এলোচিন্তা)



(১)

জ্যাক ম্যাকাই অতি আমুদে এক কার্ডিয়াক সার্জন । অপারেশন করেন গান শুনতে শুনতে। এ ব্যাপারটা থেকে তার দক্ষতার বিষয়টা আঁচ করা যায়। সফল ডাক্তার,বিত্ত বৈভবের মালিক। ঘরে সুন্দরী প্রেমময়ী স্ত্রী আর ফুটফুটে ছেলে। জীবনের মঙ্গলবাহু জড়িয়ে রাখে ভদ্রলোককে। মজা করতে খুব পছন্দ করেন। হাস্যজ্জল এ সার্জন তার ইন্টার্নদের শেখান খুব সহজ ভাষায় "Get in, Fix it, Get out. Do not attach yourself with your patient."

পেশাদারিত্বই তার কাছে সবচেয়ে বড় গুন বলে বিবেচিত হয়। আবেগ একেবারে ঠুনকো জ্ঞান করেন।

এ সময় তার জীবনের গল্পে একটা মোড় আসে। বেশ কিছুদিন ধরে গলা ব্যথা আর কাশির সমস্যা হতে থাকে তার । তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেও শেষমেশ ডাক্তার দেখান। নিজের হাসপাতালেই। রোগটা বেশ খারাপ , লারিঞ্জিয়াল টিউমর ধরা পড়ে তার। আরও কিছু টেস্ট এর পর বোঝা যায় ডাক্তার সাহেবের ক্যান্সার হয়েছে। ফলাফল রাতারাতি ডাক্তার হয়ে যান রোগী।

দিনের পর দিন হাসপাতালে বিভিন্ন ফর্ম পুরন করতে করতে, ডাক্তার এর অপেক্ষায় উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকতে
থাকতে তিনি ধীরে ধীরে কিছু ব্যাপার বুঝতে শুরু করেন। অসুস্থ মানুষ আর তার স্বজনেরা আসলে কোন অবস্থায় থাকেন আর কি অনুভব করেন। রেডিয়েশন সেন্টারে বিষাদ নিয়ে দেখতে থাকেন জীবন তার পাশা উল্টে দিয়েছে। ঘরে বাইরে জীবন অসহ্য বোধ হতে থাকে তার।

এমন সময় তার পরিচয় হয় ব্রেন টিউমরে আক্রান্ত মেয়ে জুনের সাথে, বন্ধুত্বও হয়। ডাক্তার হিসেবে সারাজীবন যা করেছেন তাই করেন তিনি, মিথ্যে আশা দেন মেয়েটিকে। দিন পার হতে থাকে। রোগী হয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে পড়তে তিনি বুঝতে থাকেন ডাক্তার হিসেবে কতটা অমানবিক আচরন করেছেন কিছু মানুষের সাথে। একসময় তার বন্ধুটি টের পান তিনি মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন। ততদিনে জ্যাকও বুঝতে পারেন সিস্টেমের গলদগুলো আর চিকিৎসা ব্যবস্থার অমানবিক দিকগুলো তাকে বিস্মিত করে। নিজে আক্রান্ত হয়ে তিনি বুঝতে শুরু করেন কোন অবস্থায় একজন মানুষ ডাক্তার এর কাছে আসে। সিনেমার গল্প এগিয়ে যায় নিজের গতিতে। সবার জন্য হয়তো নয় কিন্তু একজন চিকিৎসক বা হবু চিকিৎসকের জন্য চমৎকার একটা গল্প। শেষটা নিজেই দেখুন। ১৯৯১ সালের এ সিনেমার নাম...

The Doctor.

সিনেমাটার লিংক ঃ

IMDB Link

ডাউনলোড লিংক

(২)

Laryngeal carcinoma, Brain Tumor, Ewing Sarcoma.... এসব হাজারটা ল্যাটিন নাম মুখস্ত করে আসা ডাক্তাররা একসময় তার রোগীদেরকে রোগের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। অবলীলায় বলতে থাকেন অমুক নাম্বার বেডের Bronchial carcinoma... টার্মিনাল । মানুষগুলো পেশেন্ট হতে গিয়ে কিছু বিদঘুটে ল্যাটিন নাম হয়ে যায়। পেশাদারিত্বের দেয়ালের দুপাশে অসহায় দুদল মানুষ একে অন্যের কাছে পৌঁছুবার চেষ্টা করেন ,পারেন না।

ডাক্তার বুঝতে পারেন শক্ত শক্ত নামের রোগ আর তাদের চিকিৎসা। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারেন না তার সামনে বসে থাকা মানুষদের । রোগীর চারপাশ ঘিরে থাকা মানুষদের কথাও তারা বেমালুম ভুলে যান, তাদের ভুলে যেতে হয় । স্বামীর উদ্দেগ, স্ত্রীর দুশ্চিন্তা , সন্তানের ভয় , মা বাবার শঙ্কা, কত কান্না আর প্রার্থনা পার হয়ে একটা মানুষ কতটা অসহায় হয়ে তার সাহায্য চাইতে এসেছেন সেটা তার চোখে ধরা পড়ে না।

রোগীরা বুঝতে পারেন না তাদের ব্যথা কষ্ট কান্না এসব কি ডাক্তার বা অন্যদের স্পর্শ করে না। কেন তারা নির্বিকার আছেন, কেন নিজেরা হাসছেন বা মজা করছেন ?কেন সময় দেন না? সময়মত কেন সব টেস্ট হচ্ছে না? কেন এত অপেক্ষা করতে হবে? তারাও ভুলে যান তার সামনে সাদা পোষাক পড়া মানুষটিও শেষ পর্যন্ত একজন মানুষ। তারও জীবন আছে, ঘর আছে, আত্মীয় পরিজন আছে, পরিবারের দায়িত্ব আছে। তিনি নিজে যেমন তার কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে মজা করেন, ডাক্তাররাও তাই। মানুষের জীবনের অসহায়ত্বের অনুষঙ্গই যে তার কর্মস্থল। কি করবেন তারা?

কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বড়ভাই রোড এক্সিডেন্ট করে আহত হলে বন্ধুটা খুব বিপদে পড়ে যায়। ডাক্তার কমিউনিটির জন্য দিন রাত ভুলে অনলাইনে অফলাইনে কাজ করে যাওয়া লড়াকু-ত্যাগী এ মানুষটা রোগীর স্বজন হিসেবে হাসপাতালে দাড়াতেই তার নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশ হয়ে পড়ে তার দেশের চিকিৎসকদের উপর। অব্যবস্থাপনা, দালালদের দৌরাত্ত আর চিকিৎসকদের রুঢ ব্যবহার অবাক করে দেয় তাকে। তবে কাদের জন্য এতো লেখা , কাদের জন্য রাত জেগে কিবোর্ডে ঝড় তোলা নষ্ট মিডিয়ার প্রতি অপবাদের অপপ্রচারের জবাব দেয়া? প্রশ্নগুলো মনে আসতেই আস্তে আস্তে সে তার কাজ গুটিয়ে নেয়। আসলে রোগীর স্বজন হিসেবে কতটা অসহায় লাগে জীবনে যারা কখনো হননি তাদেরকে বোঝানোটা কষ্ট।

আর ডাক্তাররা, নিজের পরিবার সামলে, ডিগ্রির চিন্তা মাথায় নিয়্‌ সারাদিন রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে( মাঝে মাঝে অনারারীর বেগার খেটে) কতটা মানবিক আচরন করতে পারবেন তা একটু ভেবে দেখার সময় কি আসে নি?

তবে শেষমেষ আমার অতি প্রিয় একজন মানুষের কথা দিয়ে লেখাটার সমাপ্তি আনতে চাই।

আধুনিক Palliative care এর জননী সদাহাস্যোজ্জল এই ভদ্রমহোদয়ার নাম Dame Cicely Saunders. চিকিৎসাবিজ্ঞান যাদের বলে দিয়েছে আপনার জন্য আমাদের কিছু করার নেই। সময় বেধে দেয়া হয়েছে যাদের আয়ুর
(যেমনঃ End stage Cancer Patients)। তাদের জন্য নতুন ধরনের হাসপাতাল তৈরি করে গেছেন তিনি । নাম Hospice... । রোগের কাছে হেরে যেতে থাকা জীবনগুলোকে হারতে না দেবার সেই প্রতিজ্ঞা সবাই করে না। সব ডাক্তার সাহেব কি সত্যিই তার রোগীকে বুকের ভেতর থেকে বলতে পারে...


"You matter because you are you, and you matter to the last moment of your life. We will do all we can not only to help you die peacefully, but also to live until you die."


"আমি আছি ভয় নেই।"

এ ধারনাটা যদি সিসিলি সান্ডারস এর মতো বিপন্ন মানুষের কাছে পৌঁছাতে না-ই পারি তবে চিকিৎসক হবার সার্থকতা কোথায়?

বড় ডাক্তার হবার দৌড়ে ছুটতে ছুটতে একটা সত্যিকারের মানুষ আর ভালো ডাক্তার হবার ইচ্ছেটা যেন মরে না যায়। বড় ডাক্তার, প্রফেশনাল ডাক্তার, রাজনীতি করা ডাক্তার মেডিকেল এডুকেশনের ফ্যাক্টরি থেকে ক্রমাগত বের হচ্ছে।মহোদয়রা , কিছু ভালো ডাক্তারও তৈরি হচ্ছে তো?
 না হলে কিন্তু সমূহ বিপদ।