''ছেলে তো থাকে না বাবা, একলাই থাকি। আমি আর আমার এই দুই নাতি নাতনী।"
বৈশাখের মাঝামাঝির দুপুর। রোদের তীব্রতা থাকলেও গাছপালা থাকায় গরম অতটা অসহনীয় হয়ে উঠে নি আর এই ছোট্ট দলটাও বেশ মনমতোই হয়েছে। নামের শেষে বাদশা টাইটেল থাকায় কিনা জানি না, সহপাঠী সাগর , বাদশার মতোই অতি দ্রুত অবস্থার নিয়ন্ত্রন নিয়ে তার সৈন্য সামন্ত দিয়ে আজকের যুদ্ধ (জরিপ!) শুরু করে দিতে চাইলো। এক্ষেত্রে তার সৈন্য সামন্ত সাকুল্যে ছয়। সৈন্যদলে আছে বীর চট্টলার ব্যাকব্রাশ করা স্মার্ট গোছানো বীর, আতিক। কম্পিউটার থেকে দূরে থাকায় অনলাইন গেম 'লল' খেলতে না পেরে বিরহকাতর ব্রজ। আপাদমস্তক শোকের কালো পোষাক শরীরে ধারন করেও অতি উৎফুল্ল শরমী।ফমেক ইতিহাস কুখ্যাত অলস হলেও সুখ্যাত গিটারিস্ট, ইকবাল। বোরখায় শুধু চোখদুটি বের করা নিনজা কন্যা মরিয়ম। আর সবশেষ, ঊন মানুষ অভাজন আমি।
পীচ রাস্তা ধরে গ্রামের ভেতরের দিকে হাটা ধরলাম সবাই। চারপাশে কেমন গ্রাম গ্রাম সোদাগন্ধ। এদিক ওদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মাথায় থোকা থোকা আগুন রং এর ফুল ফুটেছে।কড়া রং ফুলগুলো সাদা মেঘের দাগ লাগানো হালকা নীল আকাশের পটভূমিতে যেন চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বারবার দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায়। গ্রীষ্ম তো ফলের সময়, আম কাঁঠাল গাছগুলোতে কাঁচা ফল পাকবার অপেক্ষায় রোদ পোহাচ্ছে। লিচু গাছগুলোয় সবে ফলের আগমনী বাজছে ছোট ছোট থোকায়। সফেদা আতা আরও কত গাছ গ্রামের বাড়িগুলোর উঠোনে আর পথের ধারে। ফল গাছ ছাড়াও শাল আর মেহগনিগুলো সদম্ভে মাথা উচু করে ছায়া দিচ্ছে এখানে ওখানে। পথের ধারে ঘাসের উপর কি একটা বেগুণী রঙ এর ঘাসফুল ফুটে আছে জোড়ায় জোড়ায়, নাম জানি না। রবীন্দ্রনাথ হলে নিজেই বোধকরি নাম দিয়ে দিতেন 'বাগানবিলাস' এর এর মতো... 'যুগল ফুল' । গ্রামের জমিতে খুব একটা চাষ আর এখন হয় না বোঝা যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা পতিত জমিতে বুনোঘাসের শীষ মাথা তুলেছে। দূর থেকে দেখলে সদ্য জাগা কাশফুল বলে ভুল হয়।
একে অন্যকে সাহস দিয়ে প্রথম বাড়িটার সামনে গেলাম। বাড়ির সীমানা বেড়া আর দরজা টিনের, গেটের পাশে টিনটায় ফাটল ধরেছে। ভেতরে তাকাতেই শ্যাওলামাখা চওড়া উঠোন চোখে পড়লো। যাই হোক, অস্বস্তি ভেঙ্গে দরজায় টোকা দিলাম আমরা। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। পরিচয় দেবার পর বাড়িতে বয়স্ক কেও আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে জানা গেল দুজন আছেন।
মহিলা আমাদের পথ দেখিয়ে তাদের ঘরটায় নিয়ে গেলেন। টিনের দোচালা ঘর,মাটির মেঝে। ঘরে ঢুকতেই যেটা চোখে পড়লো সেটা বিশাল একটা বিছানা। দুটো বড় চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে বোঝা গেলো। বিছানার ধারেই বসে আছেন এক অতশীপর দম্পতি। বৃদ্ধ বিছানার পাশের টেবিলে রাখা প্লেট থেকে কিছু একটা খাচ্ছেন আর বৃদ্ধা বসে আছেন চুপচাপ। এ বৃদ্ধার একটা ব্যাপার বেশ মজার লাগলো। তার চোখে হালফ্যাশনের রোদচশমা । চোখে ছানীর অপরেশন হয়েছে তাই পরে আছেন।পাকা ডালিমরাঙ্গা বৃদ্ধাকে বেশ লাগছে কালো রোদচশমায়। আর বৃদ্ধ বেশ সপ্রতিভ, আমাদের বসতে চেয়ার দিতে হুকুম করে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন।যৌবনে শক্তি ধরতেন বোঝা যায়। জানা গেলো কোন এক চরে চেয়ারম্যান ছিলেন পয়ত্রিশ বছর।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের হাতে হাতে জরিপের কাগজ, কিন্তু দেখা গেলো পেনসিলে কাজ করতে হবে। যথারীতি ছেলেরা কেউই পেন্সিলের ভার বয়ে আনতে পারে নি, দুই মহিয়সীই ভরসা। প্রশ্নপর্ব শুরু হলো। দুজনই বেশ মজা পাচ্ছিলেন। একটা বয়সের পর মানুষের কেবলই মনে হতে থাকে তাকে ঠিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তারা সে বয়স পার করে আসা মানুষ হওয়ায়, ক্ষনিকের পাওয়া এ গুরুত্ব তারা বেশ উপভোগ করছেন বোঝা গেল।
আস্তে আস্তে ইনহিবিশন কেটে গেল। বলা চলে তখন মুক্ত বিহঙ্গের দলের মতো এ বাড়ি ও বাড়িতে হামলা চালালো বাদশা সাগরের সৈন্যরা । না, নজরানার সোনাদানার খোঁজে না, দু একজন বলিরেখা পড়া মানুষের খোঁজে। বহু মানুষের কারিগর রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার, জীবনের কর্মক্লান্ত শেষ বয়সের কৃষাণ কৃষাণী, টাকা পয়সা বাদ দিয়ে এখন পাপ পুণ্যের হিসেবে ব্যস্ত অবসরে যাওয়া ব্যবসায়ী, সেই কৈশর থেকে জীবনের শেষভাগে এসেও পরিবার সামলানো গৃহবধূরা, এদের সকলের সাথেই কথা হলো। তাদের বহুদর্শী চোখে অতীত জীবনযুদ্ধের স্পষ্ট ছাপ , তাদের কথায় জীবনের পথ পাড়ি দেবার ক্লান্ত সুর আর ব্যবহারে প্রাচীন বাংলার আতিথীয়তা। সরল মানুষগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মতই সবুজাভ কোমলতা এখনো আছে। প্রকৃতির সাথে অবিরত সংগ্রাম করে টিকে থেকে জীবনের শেষ প্রন্তে শান্তি খুঁজে পাওয়া এ বয়োবৃদ্ধদের বড়ো ভালো লাগলো।
এর মধ্যেই দলের লম্বা সদস্যদের লজ্জা দিয়ে লাফিয়ে আম পেড়ে সে আম আবার এক বাড়িতে ঝাললবন দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করে ফেলল শরমী। সে বাড়িতে ও বেশ কিছু আম উপহারও পেলো । বাড়ির মহিলারা তার কাঁচা আম প্রীতি দেখে মুগ্ধ! আমরা মুগ্ধ গ্রামের মানুষের আতিথীয়তায়। দলে পুরুষ সদস্যরা যে আসলে অতি অকর্মণ্য তা এ মহোদয়া স্বল্প সময়ে প্রমান করার চেষ্টা করলেন! শুধুমাত্র বাদশা ভাইই এক বাড়িতে ছেলেদের ইজ্জত রক্ষার্থে একাই চা- বিস্কুট খেয়ে নিজের ফর্মে চায়ের দাগ ফেলে দিলে কিছুটা মুখরক্ষা হলো আর কি!
ততোক্ষণে দল দুভাগ হয়ে কাজ করছে। আমরা জনাচারেক ঘুরতে ঘুরতে একটা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। বাড়ির বাইরে সার করে লাগানো সুপুরি গাছ। বাইরে একটা রঙ উঠা সাইনবোর্ড । খুব কষ্ট করে পড়তে হয়... সাধনা ঔষুধালয়। বাইরের প্রাচীন দেয়ালটা ইটের, মাঝে মাঝে চান-তারা আঁকা নকশা খেয়াল করে না তাকালে চোখে পড়ে না । ক্ষয়া কাঠের দরজা পেরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। দরজা বরাবর উঠোন পেরিয়ে একটা রান্নাঘর আর খাবার যায়গা । তার ছায়ায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা।পরনে ম্যাক্সি, মাথায় বড় একটা ওড়না দিয়ে দেওয়া ঘোমটার দুপাশ থেকে শন রাঙা চুল বেরিয়ে আছে।চোখে একটা রঙচটা সোনালী চশমা।প্রথম দর্শনেই আমার কেন যেন মনে হলো যেন মহিলা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কিসের?
আমরা পরিচয় পর্ব শেষ করতে না করতেই মহিলা ব্যস্ত হয়ে গেলেন আমাদের বসার ব্যবস্থা করার জন্য। তাকে সুস্থির করে আমরা কোনরকমে বসলাম। প্রশ্ন করার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে শরমী লিখছিলো। প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা আবার শুরু হলো...
"আপনার নাম?"
"লুতফুন্নাহার বেগম"
অতঃপর তার গল্প। এক ছেলের জননী এ মহিলা এখন একাই থাকেন। ছেলে দেশের বাইরে। সাথে যাদেরকে নাতি নাতনী বললেন তাদের কেও আশ্রিত আর কেও অল্প সময়ের জন্য তার সাথে আছে বোঝা যাচ্ছিলো। কথা শেষ না হতেই তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেলের শরবৎ এর গ্লাস চলে এলো হাতে হাতে। আর এলো আচার। আচারের বয়াম দেখে বোঝা গেলো অতি যত্নে তুলে রাখা জিনিস। শুধু আম আর মশলা না, মায়ের স্নেহও সে খাবারে মিশে আছে।বারবার মনে হতে লাগলো বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে এ রকম কতো বর্ষীয়সী জননী অপেক্ষা করে আছেন তার সন্তানের জন্য। বিদেশ বিভূঁই শত পথ পাড়ি দিয়ে কর্ম ক্লান্ত সন্তান ফিরে আসবে মায়ের কোলে শীতল হতে।অপেক্ষা। এই মায়েরাই তো আমাদের গ্রাম আমাদের দেশ। তারা অপেক্ষা করেন শহরের ইটের দেয়াল পেরিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে দেশের সমস্ত সন্তানেরা।
এক বৃদ্ধা জরিপে অংশ নিতে নারাজ, কারন কিছুতেই তার রক্তচাপ মাপতে দেবেন না। বললেন " আমার পোলা নাই। মাইয়াগুলার বিয়া দিসি এখন এইটা মাপলে যদি অসুখ বাইর হয়। কে দেখবো?"
সরল প্রশ্নের পেছনে জীবনের অনেক গরল লুকিয়ে আছে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আরেক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন তার যে অপারেশন করাতে হবে তার সাহায্য করার কোন উপায় আমাদের এ আর এফ এস টি থেকে হবে কিনা? তার ছেলেরা দেখে না ।কি বলা উচিত ছিলো কেও বুঝতে পারি নি।
এরা প্রায় সকলেই নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন জীবনের কোন না কোন সময়। কিন্তু দমে যান নি । নদী ভাঙন সংক্রান্ত প্রশ্নে তাদের নির্বিকার সব উত্তর তাদের জীবনের লড়াকু মানসিকতা বারবার টের পাইয়ে দেয়।
কিন্তু সময়ও তো এক না থামা নদী। সে নদীর একপাশে তারা তাদের নিজেদের জীবন ভেঙ্গে আরেক পাড়ে গড়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে। এখন এ মানুষগুলো সব দিয়ে রিক্ত হয়ে অপেক্ষায় আছেন মৃত্যুর। জরা তার থাবা বসিয়ে দিয়েছে প্রতিটি শরীরে। তারা বড় ক্লান্ত। তবু এখনো তাদের চারপাশে জীবনের তীব্র স্রোত। সন্তান, নাতি নাতনী , নতুন আসা শিশুরা। এক জীবনের শেষ আরেক জীবনের শুরু। ঈশরবুড়োর লেখা এ চক্র গল্পের যে কোন শেষ নেই। গল্প চলবে।
নীচু গলায় বলা কথাটা রঙ উঠা ক্ষয়া সোনালী ফ্রেমের চশমা পড়া জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত লুতফুন্নাহার বেগমের। কথা হচ্ছিলো তার বাড়ির উঠোনে বসে।
আবাসিক মাঠ পর্যায় প্রশিক্ষন। মেডিকেলের দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষার কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ের একটা অংশ, এক ধরনের জরিপকাজ। আমাদের জরিপের বিষয়বস্তু ছিলো নদীভাঙ্গন এলাকার বয়োবৃদ্ধ মানুষদের অবস্থা । জরিপ এলাকা চর ভদ্রাসন বেশ বর্ধিষ্ণু । গ্রামীন আবেশে শহুরে সুবিধার চিহ্ন চারিদিকে। জলরং ছবির সবুজ প্রকৃতির মাঝে মাঝে বাড়ি ঘরের ইট কাঠের ধূসরতার ছোপ। বাসটা আমাদের রাস্তার মোড়ে বিশাল এক রেন্ট্রি গাছের নিচে নামিয়ে দিয়ে সামনে চলে গেল এক এক করে বাকি সবাইকে সুবিধামতো যায়গায় পৌঁছে দিতে।আমরা বলতে আমার তিন সহপাঠী, দুই সহপাঠিনী আর আমি।
আবাসিক মাঠ পর্যায় প্রশিক্ষন। মেডিকেলের দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষার কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ের একটা অংশ, এক ধরনের জরিপকাজ। আমাদের জরিপের বিষয়বস্তু ছিলো নদীভাঙ্গন এলাকার বয়োবৃদ্ধ মানুষদের অবস্থা । জরিপ এলাকা চর ভদ্রাসন বেশ বর্ধিষ্ণু । গ্রামীন আবেশে শহুরে সুবিধার চিহ্ন চারিদিকে। জলরং ছবির সবুজ প্রকৃতির মাঝে মাঝে বাড়ি ঘরের ইট কাঠের ধূসরতার ছোপ। বাসটা আমাদের রাস্তার মোড়ে বিশাল এক রেন্ট্রি গাছের নিচে নামিয়ে দিয়ে সামনে চলে গেল এক এক করে বাকি সবাইকে সুবিধামতো যায়গায় পৌঁছে দিতে।আমরা বলতে আমার তিন সহপাঠী, দুই সহপাঠিনী আর আমি।
বৈশাখের মাঝামাঝির দুপুর। রোদের তীব্রতা থাকলেও গাছপালা থাকায় গরম অতটা অসহনীয় হয়ে উঠে নি আর এই ছোট্ট দলটাও বেশ মনমতোই হয়েছে। নামের শেষে বাদশা টাইটেল থাকায় কিনা জানি না, সহপাঠী সাগর , বাদশার মতোই অতি দ্রুত অবস্থার নিয়ন্ত্রন নিয়ে তার সৈন্য সামন্ত দিয়ে আজকের যুদ্ধ (জরিপ!) শুরু করে দিতে চাইলো। এক্ষেত্রে তার সৈন্য সামন্ত সাকুল্যে ছয়। সৈন্যদলে আছে বীর চট্টলার ব্যাকব্রাশ করা স্মার্ট গোছানো বীর, আতিক। কম্পিউটার থেকে দূরে থাকায় অনলাইন গেম 'লল' খেলতে না পেরে বিরহকাতর ব্রজ। আপাদমস্তক শোকের কালো পোষাক শরীরে ধারন করেও অতি উৎফুল্ল শরমী।ফমেক ইতিহাস কুখ্যাত অলস হলেও সুখ্যাত গিটারিস্ট, ইকবাল। বোরখায় শুধু চোখদুটি বের করা নিনজা কন্যা মরিয়ম। আর সবশেষ, ঊন মানুষ অভাজন আমি।
পীচ রাস্তা ধরে গ্রামের ভেতরের দিকে হাটা ধরলাম সবাই। চারপাশে কেমন গ্রাম গ্রাম সোদাগন্ধ। এদিক ওদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মাথায় থোকা থোকা আগুন রং এর ফুল ফুটেছে।কড়া রং ফুলগুলো সাদা মেঘের দাগ লাগানো হালকা নীল আকাশের পটভূমিতে যেন চোখে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। বারবার দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায়। গ্রীষ্ম তো ফলের সময়, আম কাঁঠাল গাছগুলোতে কাঁচা ফল পাকবার অপেক্ষায় রোদ পোহাচ্ছে। লিচু গাছগুলোয় সবে ফলের আগমনী বাজছে ছোট ছোট থোকায়। সফেদা আতা আরও কত গাছ গ্রামের বাড়িগুলোর উঠোনে আর পথের ধারে। ফল গাছ ছাড়াও শাল আর মেহগনিগুলো সদম্ভে মাথা উচু করে ছায়া দিচ্ছে এখানে ওখানে। পথের ধারে ঘাসের উপর কি একটা বেগুণী রঙ এর ঘাসফুল ফুটে আছে জোড়ায় জোড়ায়, নাম জানি না। রবীন্দ্রনাথ হলে নিজেই বোধকরি নাম দিয়ে দিতেন 'বাগানবিলাস' এর এর মতো... 'যুগল ফুল' । গ্রামের জমিতে খুব একটা চাষ আর এখন হয় না বোঝা যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা পতিত জমিতে বুনোঘাসের শীষ মাথা তুলেছে। দূর থেকে দেখলে সদ্য জাগা কাশফুল বলে ভুল হয়।
একে অন্যকে সাহস দিয়ে প্রথম বাড়িটার সামনে গেলাম। বাড়ির সীমানা বেড়া আর দরজা টিনের, গেটের পাশে টিনটায় ফাটল ধরেছে। ভেতরে তাকাতেই শ্যাওলামাখা চওড়া উঠোন চোখে পড়লো। যাই হোক, অস্বস্তি ভেঙ্গে দরজায় টোকা দিলাম আমরা। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। পরিচয় দেবার পর বাড়িতে বয়স্ক কেও আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে জানা গেল দুজন আছেন।
মহিলা আমাদের পথ দেখিয়ে তাদের ঘরটায় নিয়ে গেলেন। টিনের দোচালা ঘর,মাটির মেঝে। ঘরে ঢুকতেই যেটা চোখে পড়লো সেটা বিশাল একটা বিছানা। দুটো বড় চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে বোঝা গেলো। বিছানার ধারেই বসে আছেন এক অতশীপর দম্পতি। বৃদ্ধ বিছানার পাশের টেবিলে রাখা প্লেট থেকে কিছু একটা খাচ্ছেন আর বৃদ্ধা বসে আছেন চুপচাপ। এ বৃদ্ধার একটা ব্যাপার বেশ মজার লাগলো। তার চোখে হালফ্যাশনের রোদচশমা । চোখে ছানীর অপরেশন হয়েছে তাই পরে আছেন।পাকা ডালিমরাঙ্গা বৃদ্ধাকে বেশ লাগছে কালো রোদচশমায়। আর বৃদ্ধ বেশ সপ্রতিভ, আমাদের বসতে চেয়ার দিতে হুকুম করে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন।যৌবনে শক্তি ধরতেন বোঝা যায়। জানা গেলো কোন এক চরে চেয়ারম্যান ছিলেন পয়ত্রিশ বছর।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের হাতে হাতে জরিপের কাগজ, কিন্তু দেখা গেলো পেনসিলে কাজ করতে হবে। যথারীতি ছেলেরা কেউই পেন্সিলের ভার বয়ে আনতে পারে নি, দুই মহিয়সীই ভরসা। প্রশ্নপর্ব শুরু হলো। দুজনই বেশ মজা পাচ্ছিলেন। একটা বয়সের পর মানুষের কেবলই মনে হতে থাকে তাকে ঠিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তারা সে বয়স পার করে আসা মানুষ হওয়ায়, ক্ষনিকের পাওয়া এ গুরুত্ব তারা বেশ উপভোগ করছেন বোঝা গেল।
আস্তে আস্তে ইনহিবিশন কেটে গেল। বলা চলে তখন মুক্ত বিহঙ্গের দলের মতো এ বাড়ি ও বাড়িতে হামলা চালালো বাদশা সাগরের সৈন্যরা । না, নজরানার সোনাদানার খোঁজে না, দু একজন বলিরেখা পড়া মানুষের খোঁজে। বহু মানুষের কারিগর রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার, জীবনের কর্মক্লান্ত শেষ বয়সের কৃষাণ কৃষাণী, টাকা পয়সা বাদ দিয়ে এখন পাপ পুণ্যের হিসেবে ব্যস্ত অবসরে যাওয়া ব্যবসায়ী, সেই কৈশর থেকে জীবনের শেষভাগে এসেও পরিবার সামলানো গৃহবধূরা, এদের সকলের সাথেই কথা হলো। তাদের বহুদর্শী চোখে অতীত জীবনযুদ্ধের স্পষ্ট ছাপ , তাদের কথায় জীবনের পথ পাড়ি দেবার ক্লান্ত সুর আর ব্যবহারে প্রাচীন বাংলার আতিথীয়তা। সরল মানুষগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মতই সবুজাভ কোমলতা এখনো আছে। প্রকৃতির সাথে অবিরত সংগ্রাম করে টিকে থেকে জীবনের শেষ প্রন্তে শান্তি খুঁজে পাওয়া এ বয়োবৃদ্ধদের বড়ো ভালো লাগলো।
এর মধ্যেই দলের লম্বা সদস্যদের লজ্জা দিয়ে লাফিয়ে আম পেড়ে সে আম আবার এক বাড়িতে ঝাললবন দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করে ফেলল শরমী। সে বাড়িতে ও বেশ কিছু আম উপহারও পেলো । বাড়ির মহিলারা তার কাঁচা আম প্রীতি দেখে মুগ্ধ! আমরা মুগ্ধ গ্রামের মানুষের আতিথীয়তায়। দলে পুরুষ সদস্যরা যে আসলে অতি অকর্মণ্য তা এ মহোদয়া স্বল্প সময়ে প্রমান করার চেষ্টা করলেন! শুধুমাত্র বাদশা ভাইই এক বাড়িতে ছেলেদের ইজ্জত রক্ষার্থে একাই চা- বিস্কুট খেয়ে নিজের ফর্মে চায়ের দাগ ফেলে দিলে কিছুটা মুখরক্ষা হলো আর কি!
ততোক্ষণে দল দুভাগ হয়ে কাজ করছে। আমরা জনাচারেক ঘুরতে ঘুরতে একটা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। বাড়ির বাইরে সার করে লাগানো সুপুরি গাছ। বাইরে একটা রঙ উঠা সাইনবোর্ড । খুব কষ্ট করে পড়তে হয়... সাধনা ঔষুধালয়। বাইরের প্রাচীন দেয়ালটা ইটের, মাঝে মাঝে চান-তারা আঁকা নকশা খেয়াল করে না তাকালে চোখে পড়ে না । ক্ষয়া কাঠের দরজা পেরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। দরজা বরাবর উঠোন পেরিয়ে একটা রান্নাঘর আর খাবার যায়গা । তার ছায়ায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা।পরনে ম্যাক্সি, মাথায় বড় একটা ওড়না দিয়ে দেওয়া ঘোমটার দুপাশ থেকে শন রাঙা চুল বেরিয়ে আছে।চোখে একটা রঙচটা সোনালী চশমা।প্রথম দর্শনেই আমার কেন যেন মনে হলো যেন মহিলা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কিসের?
আমরা পরিচয় পর্ব শেষ করতে না করতেই মহিলা ব্যস্ত হয়ে গেলেন আমাদের বসার ব্যবস্থা করার জন্য। তাকে সুস্থির করে আমরা কোনরকমে বসলাম। প্রশ্ন করার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে শরমী লিখছিলো। প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা আবার শুরু হলো...
"আপনার নাম?"
"লুতফুন্নাহার বেগম"
অতঃপর তার গল্প। এক ছেলের জননী এ মহিলা এখন একাই থাকেন। ছেলে দেশের বাইরে। সাথে যাদেরকে নাতি নাতনী বললেন তাদের কেও আশ্রিত আর কেও অল্প সময়ের জন্য তার সাথে আছে বোঝা যাচ্ছিলো। কথা শেষ না হতেই তিনি আমাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেলের শরবৎ এর গ্লাস চলে এলো হাতে হাতে। আর এলো আচার। আচারের বয়াম দেখে বোঝা গেলো অতি যত্নে তুলে রাখা জিনিস। শুধু আম আর মশলা না, মায়ের স্নেহও সে খাবারে মিশে আছে।বারবার মনে হতে লাগলো বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে এ রকম কতো বর্ষীয়সী জননী অপেক্ষা করে আছেন তার সন্তানের জন্য। বিদেশ বিভূঁই শত পথ পাড়ি দিয়ে কর্ম ক্লান্ত সন্তান ফিরে আসবে মায়ের কোলে শীতল হতে।অপেক্ষা। এই মায়েরাই তো আমাদের গ্রাম আমাদের দেশ। তারা অপেক্ষা করেন শহরের ইটের দেয়াল পেরিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে দেশের সমস্ত সন্তানেরা।
এক বৃদ্ধা জরিপে অংশ নিতে নারাজ, কারন কিছুতেই তার রক্তচাপ মাপতে দেবেন না। বললেন " আমার পোলা নাই। মাইয়াগুলার বিয়া দিসি এখন এইটা মাপলে যদি অসুখ বাইর হয়। কে দেখবো?"
সরল প্রশ্নের পেছনে জীবনের অনেক গরল লুকিয়ে আছে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আরেক বৃদ্ধা জানতে চাইলেন তার যে অপারেশন করাতে হবে তার সাহায্য করার কোন উপায় আমাদের এ আর এফ এস টি থেকে হবে কিনা? তার ছেলেরা দেখে না ।কি বলা উচিত ছিলো কেও বুঝতে পারি নি।
এরা প্রায় সকলেই নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন জীবনের কোন না কোন সময়। কিন্তু দমে যান নি । নদী ভাঙন সংক্রান্ত প্রশ্নে তাদের নির্বিকার সব উত্তর তাদের জীবনের লড়াকু মানসিকতা বারবার টের পাইয়ে দেয়।
কিন্তু সময়ও তো এক না থামা নদী। সে নদীর একপাশে তারা তাদের নিজেদের জীবন ভেঙ্গে আরেক পাড়ে গড়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে। এখন এ মানুষগুলো সব দিয়ে রিক্ত হয়ে অপেক্ষায় আছেন মৃত্যুর। জরা তার থাবা বসিয়ে দিয়েছে প্রতিটি শরীরে। তারা বড় ক্লান্ত। তবু এখনো তাদের চারপাশে জীবনের তীব্র স্রোত। সন্তান, নাতি নাতনী , নতুন আসা শিশুরা। এক জীবনের শেষ আরেক জীবনের শুরু। ঈশরবুড়োর লেখা এ চক্র গল্পের যে কোন শেষ নেই। গল্প চলবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন