মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

ছাইপাঁশে আঁকা ছবি

মন ভালো না লাগা ব্যাধিবিশেষ না হলেও ব্যাধবিশেষ তো অবশ্যই। এ সময়গুলোতে মনের সমস্ত বিষয় একমতভাবে থাকে না। নিজের সাথে নিজের কেমন যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মনের খারাপ এক অংশ খুবলে খায় অন্য অংশগুলোকে। নিজের ভেতরে জারি হয় সামরিক শাসন। একনায়কের মতো 'মন খারাপ মন' শরীর আর মনকে যেদিকে খুশি টেনে নিয়ে যায়। মনের ভেতর কামানের আওয়াজের মতো অনেকের কণ্ঠস্বরের বিহ্বলতা নিজেকে গ্রাস করতে থাকে। ফেলে আসা যায়গাগুলো ট্যাঙ্কের চাকার মতো মনের জমিনে দাগ কাটতে শুরু করে। সদ্যজাত পাখির অশক্ত ডানার মতো মনে হয় নিজেকে।

সারাদিন সারারাত আছন্নতায় কাটে। আবার আরেকটা সকাল শুরু ঠিক কখন হয়ে গেলো বুঝতে পারা যায় না। মনের অলিতে গলিতে যেন মূর্ছনার আসর বসে। ফাঁপা মগজের কোথাও ক্রমাগত রবীশংকরের সেতারের সাথে ম্যানহুইনের বেহালার সুতীব্র সঙ্গত। এ পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হয়। মানুষ ছাড়া আর সব ভালো লাগে। মানুষদেরকেই কেবল বীভৎস মনে হয়।

মনের আকাশে ছাইরাঙ্গা মেঘ ঢেকে দিয়ে যায় অতীত। নিজেকে আর কিছুতেই চিনতে পারা যায় না। অতীতের পথে ঘন কুয়াশা। নিজেকে দেখা যায় না। কেমন করে সে মানুষটা জন্মে গেলো? কবে ? কবে নিজেকে আলাদা বলে চিনেছে? কতোটা পথ হেঁটে নিজেকে জেনেছে? নাকি কিচ্ছু জানে না এখনো? সে এতো তীব্র নিঃসঙ্গতার বিষে মাতাল কেন? সংঘ ও সঙ্গ এতো অসহ্য মনে হয় কেন?

অতীত প্রাসাদের বহু স্মৃতি কামরায় নিজের লাগানো তালা। চাবি কোথায় হারিয়েছে সেটাও মনে করতে বাধে। মাঝে
মাঝে নিজের ভেতরকার দানবের সাথে কথা হয়। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরের মানুষের সাথে। বন্ধ দরজার ওপারে দাড়িয়ে নিজের দানব আর নিজের মানুষগুলোকে নেড়ে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু দরজাগুলো খোলার সাহস আর হয় না।

অনেক সময় কিসব অবাক অনুভূতির টুকরো এসে আঘাত করে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য নিজেকে ছোয়া যায়। সেই অনুভূতিগুলোই কি আমার অবচেতনের পাঠানো চিঠি কিনা তা আমি জানি না। আর পাঠালেও সে চিঠি কখনো খুলে দেখিনি।

জীবনটাকে নিয়ে কি করা উচিত সেটা কখনোই বুঝতে পারি না, পারবো বলেও মনে হয় না। নিজের ভেতরকার তীব্র মানুষটি, যার সাথে আমার তুমুল সহবাস আদি-অন্ত, তাকে কখোনো ছুঁয়ে দেখা গেলো না। বুঝতে পারা গেলো না।

বাইরের এই খোলসের ভেতরে পোরা অস্তিত্বকে খুঁজে দেখাটা খুব দরকার। সে আসলে কি চায়? কোন প্রশ্নের উত্তর চাই তার? কোন প্রশ্নগুলো সে করতে যায় জগতের উত্তরের প্রতি?
জানাটা ভীষন দরকার, অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

 অন্যকে জানানোর নিজেকে চেনানোর চেয়ে নিজেকে চেনা-জানাটাই ক্রমশ জরুরী হয়ে উঠছে। ভালো লাগা না লাগার যুগলবন্দীর এ অপার্থিব জীবন কেন তার উত্তরের কিয়দাংশের কিছুটা জানা গেলেও বেশ হতো।


দেখানোর আসলে কিছু নেই। নেই আরোপিত উদাসীনতার কোন মানে। নিজের মনের ঝড়ের নবম সংকেত
আসলে কারো বন্দরেই পৌঁছোয় না। নিজের দুঃখের ঢেউগুলো চিরে ফেলে নিজেকেই এগুতে হয়। একাই অশক্ত হাতে ধরতে হয় শক্ত হাল। ঝড়ের পর ঝড় পেড়িয়ে একা অভিশপ্ত  জাহাজীর মতো টেনে নেয়া জীবন। একাই শেষ করতে চাই সব।লগবুকে কিচ্ছু থাকবে না। অজস্র গল্প জমা বুক নিয়ে চুপচাপ বন্দরে পৌঁছুবো একদিন।কাওকে কিছু না বলে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেব। কেও না জানলো আমার গল্প। সাগরের পাড়ে চুপ করে বসে দেখবো কতোটা পেরিয়ে এলাম। কি অদ্ভূতুড়ে ছিলো আমার নেশাতুর একাকীত্বের জীবন। শেষমেষ একদিন সাগরের বুকে ঝরে পড়া অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটার একটার মতো ঝরে যাবো এই পার্থিব জগতের অপার্থিবতার মেঘের বুক থেকে। ভেসে বেড়ানোর খেলা শেষে অকিঞ্চিৎকর জীবন শেষ হয়ে মিশে যাবে থমকে থেকেও উত্তাল জীবনের মহাসমুদ্রের জলে।