সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

ডাক্তার আছেন? (মুভি স্পয়লার আর এলোচিন্তা)



(১)

জ্যাক ম্যাকাই অতি আমুদে এক কার্ডিয়াক সার্জন । অপারেশন করেন গান শুনতে শুনতে। এ ব্যাপারটা থেকে তার দক্ষতার বিষয়টা আঁচ করা যায়। সফল ডাক্তার,বিত্ত বৈভবের মালিক। ঘরে সুন্দরী প্রেমময়ী স্ত্রী আর ফুটফুটে ছেলে। জীবনের মঙ্গলবাহু জড়িয়ে রাখে ভদ্রলোককে। মজা করতে খুব পছন্দ করেন। হাস্যজ্জল এ সার্জন তার ইন্টার্নদের শেখান খুব সহজ ভাষায় "Get in, Fix it, Get out. Do not attach yourself with your patient."

পেশাদারিত্বই তার কাছে সবচেয়ে বড় গুন বলে বিবেচিত হয়। আবেগ একেবারে ঠুনকো জ্ঞান করেন।

এ সময় তার জীবনের গল্পে একটা মোড় আসে। বেশ কিছুদিন ধরে গলা ব্যথা আর কাশির সমস্যা হতে থাকে তার । তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেও শেষমেশ ডাক্তার দেখান। নিজের হাসপাতালেই। রোগটা বেশ খারাপ , লারিঞ্জিয়াল টিউমর ধরা পড়ে তার। আরও কিছু টেস্ট এর পর বোঝা যায় ডাক্তার সাহেবের ক্যান্সার হয়েছে। ফলাফল রাতারাতি ডাক্তার হয়ে যান রোগী।

দিনের পর দিন হাসপাতালে বিভিন্ন ফর্ম পুরন করতে করতে, ডাক্তার এর অপেক্ষায় উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকতে
থাকতে তিনি ধীরে ধীরে কিছু ব্যাপার বুঝতে শুরু করেন। অসুস্থ মানুষ আর তার স্বজনেরা আসলে কোন অবস্থায় থাকেন আর কি অনুভব করেন। রেডিয়েশন সেন্টারে বিষাদ নিয়ে দেখতে থাকেন জীবন তার পাশা উল্টে দিয়েছে। ঘরে বাইরে জীবন অসহ্য বোধ হতে থাকে তার।

এমন সময় তার পরিচয় হয় ব্রেন টিউমরে আক্রান্ত মেয়ে জুনের সাথে, বন্ধুত্বও হয়। ডাক্তার হিসেবে সারাজীবন যা করেছেন তাই করেন তিনি, মিথ্যে আশা দেন মেয়েটিকে। দিন পার হতে থাকে। রোগী হয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে পড়তে তিনি বুঝতে থাকেন ডাক্তার হিসেবে কতটা অমানবিক আচরন করেছেন কিছু মানুষের সাথে। একসময় তার বন্ধুটি টের পান তিনি মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন। ততদিনে জ্যাকও বুঝতে পারেন সিস্টেমের গলদগুলো আর চিকিৎসা ব্যবস্থার অমানবিক দিকগুলো তাকে বিস্মিত করে। নিজে আক্রান্ত হয়ে তিনি বুঝতে শুরু করেন কোন অবস্থায় একজন মানুষ ডাক্তার এর কাছে আসে। সিনেমার গল্প এগিয়ে যায় নিজের গতিতে। সবার জন্য হয়তো নয় কিন্তু একজন চিকিৎসক বা হবু চিকিৎসকের জন্য চমৎকার একটা গল্প। শেষটা নিজেই দেখুন। ১৯৯১ সালের এ সিনেমার নাম...

The Doctor.

সিনেমাটার লিংক ঃ

IMDB Link

ডাউনলোড লিংক

(২)

Laryngeal carcinoma, Brain Tumor, Ewing Sarcoma.... এসব হাজারটা ল্যাটিন নাম মুখস্ত করে আসা ডাক্তাররা একসময় তার রোগীদেরকে রোগের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। অবলীলায় বলতে থাকেন অমুক নাম্বার বেডের Bronchial carcinoma... টার্মিনাল । মানুষগুলো পেশেন্ট হতে গিয়ে কিছু বিদঘুটে ল্যাটিন নাম হয়ে যায়। পেশাদারিত্বের দেয়ালের দুপাশে অসহায় দুদল মানুষ একে অন্যের কাছে পৌঁছুবার চেষ্টা করেন ,পারেন না।

ডাক্তার বুঝতে পারেন শক্ত শক্ত নামের রোগ আর তাদের চিকিৎসা। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারেন না তার সামনে বসে থাকা মানুষদের । রোগীর চারপাশ ঘিরে থাকা মানুষদের কথাও তারা বেমালুম ভুলে যান, তাদের ভুলে যেতে হয় । স্বামীর উদ্দেগ, স্ত্রীর দুশ্চিন্তা , সন্তানের ভয় , মা বাবার শঙ্কা, কত কান্না আর প্রার্থনা পার হয়ে একটা মানুষ কতটা অসহায় হয়ে তার সাহায্য চাইতে এসেছেন সেটা তার চোখে ধরা পড়ে না।

রোগীরা বুঝতে পারেন না তাদের ব্যথা কষ্ট কান্না এসব কি ডাক্তার বা অন্যদের স্পর্শ করে না। কেন তারা নির্বিকার আছেন, কেন নিজেরা হাসছেন বা মজা করছেন ?কেন সময় দেন না? সময়মত কেন সব টেস্ট হচ্ছে না? কেন এত অপেক্ষা করতে হবে? তারাও ভুলে যান তার সামনে সাদা পোষাক পড়া মানুষটিও শেষ পর্যন্ত একজন মানুষ। তারও জীবন আছে, ঘর আছে, আত্মীয় পরিজন আছে, পরিবারের দায়িত্ব আছে। তিনি নিজে যেমন তার কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে মজা করেন, ডাক্তাররাও তাই। মানুষের জীবনের অসহায়ত্বের অনুষঙ্গই যে তার কর্মস্থল। কি করবেন তারা?

কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বড়ভাই রোড এক্সিডেন্ট করে আহত হলে বন্ধুটা খুব বিপদে পড়ে যায়। ডাক্তার কমিউনিটির জন্য দিন রাত ভুলে অনলাইনে অফলাইনে কাজ করে যাওয়া লড়াকু-ত্যাগী এ মানুষটা রোগীর স্বজন হিসেবে হাসপাতালে দাড়াতেই তার নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশ হয়ে পড়ে তার দেশের চিকিৎসকদের উপর। অব্যবস্থাপনা, দালালদের দৌরাত্ত আর চিকিৎসকদের রুঢ ব্যবহার অবাক করে দেয় তাকে। তবে কাদের জন্য এতো লেখা , কাদের জন্য রাত জেগে কিবোর্ডে ঝড় তোলা নষ্ট মিডিয়ার প্রতি অপবাদের অপপ্রচারের জবাব দেয়া? প্রশ্নগুলো মনে আসতেই আস্তে আস্তে সে তার কাজ গুটিয়ে নেয়। আসলে রোগীর স্বজন হিসেবে কতটা অসহায় লাগে জীবনে যারা কখনো হননি তাদেরকে বোঝানোটা কষ্ট।

আর ডাক্তাররা, নিজের পরিবার সামলে, ডিগ্রির চিন্তা মাথায় নিয়্‌ সারাদিন রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে( মাঝে মাঝে অনারারীর বেগার খেটে) কতটা মানবিক আচরন করতে পারবেন তা একটু ভেবে দেখার সময় কি আসে নি?

তবে শেষমেষ আমার অতি প্রিয় একজন মানুষের কথা দিয়ে লেখাটার সমাপ্তি আনতে চাই।

আধুনিক Palliative care এর জননী সদাহাস্যোজ্জল এই ভদ্রমহোদয়ার নাম Dame Cicely Saunders. চিকিৎসাবিজ্ঞান যাদের বলে দিয়েছে আপনার জন্য আমাদের কিছু করার নেই। সময় বেধে দেয়া হয়েছে যাদের আয়ুর
(যেমনঃ End stage Cancer Patients)। তাদের জন্য নতুন ধরনের হাসপাতাল তৈরি করে গেছেন তিনি । নাম Hospice... । রোগের কাছে হেরে যেতে থাকা জীবনগুলোকে হারতে না দেবার সেই প্রতিজ্ঞা সবাই করে না। সব ডাক্তার সাহেব কি সত্যিই তার রোগীকে বুকের ভেতর থেকে বলতে পারে...


"You matter because you are you, and you matter to the last moment of your life. We will do all we can not only to help you die peacefully, but also to live until you die."


"আমি আছি ভয় নেই।"

এ ধারনাটা যদি সিসিলি সান্ডারস এর মতো বিপন্ন মানুষের কাছে পৌঁছাতে না-ই পারি তবে চিকিৎসক হবার সার্থকতা কোথায়?

বড় ডাক্তার হবার দৌড়ে ছুটতে ছুটতে একটা সত্যিকারের মানুষ আর ভালো ডাক্তার হবার ইচ্ছেটা যেন মরে না যায়। বড় ডাক্তার, প্রফেশনাল ডাক্তার, রাজনীতি করা ডাক্তার মেডিকেল এডুকেশনের ফ্যাক্টরি থেকে ক্রমাগত বের হচ্ছে।মহোদয়রা , কিছু ভালো ডাক্তারও তৈরি হচ্ছে তো?
 না হলে কিন্তু সমূহ বিপদ।







শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৫

ভাবনা-চিন্তা খেলা ১

 ইদানীং মাঝে মাঝেই বড় অসহায় হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি এবং আমরা কি দিন দিন নষ্টদের দলে নাম লেখাচ্ছি। বুঝতে পারি না। আমার নিজের সমস্ত কাজই তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় প্রতিটা কাজেরই একটা গুঢ় উদ্দেশ্য আছে। যেটা বিশেষ সুবিধার না।
আমার বাজানো, লেখা, পড়া সবই কি অন্যকে দেখানোর জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয়, না, কখনোই না। আবার মাঝে সাঝে চরম গ্লানিবোধ হয়, যে আমি বোধকরি কিছু সস্তা হাততালি আর পিঠচাপড়ের জন্য আমার সমস্ত কাজ করছি।

আসলে চারিদিকের মানুষদের দেখলে মনে হয় তারা কেও নিজের জন্য কোন কিছু করছে না। অন্যকে বিচার করা খুব খারাপ ব্যাপার। কারন আমার নিজের মনে হয়,

The defect we see in people actually are the reflection of our own. It's like matching puzzle pieces of a monster. When I see one of my own piece,I recognize it.So, the fault of others we see are the same faults we harbor within us.

তাই বড় ভয় হয়।  আমি ভীষন ভীতু একজন মানুষ হিসেবে বড় হয়েছি। আমার নিজের কথা মনে হলেই মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ড এর একটা গানের কথা মনে হয়..

"বাড়লে বয়স সবাই মানুষ হয় কি?
শুনলে কথা মানুষ চেনা যায় কি?"

আমার বয়স হয়তো হয়েছে, ঠিক বড় হয়ে উঠতে পারলাম না।

আরেকদিকে, মানসিকভাবে আমি মোটেও শক্তিশালী নই। পরবর্তীতে হতে পারা না পারার প্রশ্নটা ভবিষ্যৎ এর। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমার মানসিক শক্তি দৈন্যদশা আর কিছু কুরে খাওয়া ব্যাধির মতো ভয় বড় ভোগাচ্ছে। ভালো লাগে না কিছু।

আশেপাশের মানুষেরা যেন অন্যকে টেনে নিচে নামাতে আস্তাকুড় পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত।  এখন সেই আস্তাকুড়ে নেমে তাদের সাথে কথার যুদ্ধ করাটাই কি আমার মানসিকতায় আসবে। মনে হয় না। কিন্তু Ready Wit দিয়ে যে জবাব দেবো সেটাও আসে না। বড্ড সমস্যায় পড়ে গেছি।

এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা ছাড়া অদূরবর্তী সময়ে আর কোন উপায় দেখছি না। সেক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার মেনে নিতে হয়..

If you want your friends to be faultless, you will become friendless.

"বন্ধুহীন জীবন..  হা কষ্ট..  হা কষ্ট"  বিলাপ না করে যদি ভাবতে বসি আসলে আমার বন্ধু কে,  বা কারা? কজন? তবে কিন্তু সংখ্যাটা কড়ে আংগুল দিয়ে গুনে ফেলা যাবে।

বুনোহাঁস ফিল্মের একটা গান বড় বেশি শুনি আজকাল.. তেমন আহামরি কিছু নয়। তবু কেন যেন ভালো লাগে..

"তবু দেয় উড়াল একলা পাখি
জিন্দেগি কাহিন ভি থামতি নেহি"

একদিন আমি উড়াল দেবো।