শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

স্বপ্নকল্পের বাস্তবতা

মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। না জেগে থেকে অসাধারন কোন বাস্তব ভবিষ্যৎ কল্পনার কথা বলছি না। বাস্তব আর অবাস্তবের মিশেলে ঘুমের মাঝে দেখা অদ্ভুত জগত এর কথা বলছি। তবে স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ অন্য পশুদের থেকে আলাদা এমনটা না। প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ীই যে স্বপ্ন দেখে এটা এখন প্রমানিত। কিন্তু তারা বোধকরি মানুষদের মতো ঘুম থেকে উঠে একে অন্যকে বলে না  '' বড়ো আচানক খোয়াব দেখছি আইজ। হইলো কি..."  আসলে আমরা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করতে ভালোবাসি। বাজারে খোয়াবনামা বইটি এখনো বেশ বিক্রি হয় বলে জানি। তবে সে গাঁজাখুরি মেনে নিতে বাধে।আসলে মেনে নিতে কখনোই ভালোবাসিনি, সব কিছুই মেনে নেয়ার বদলে মনেই নিতে চাই।

স্বপ্ন জিনিসটা আসলে আমাদের মস্তিষ্কের একটা খেলা। আমাদের অস্তিত্বের সাথে খেলতে সে খুব ভালোবাসে বলেই স্বপ্ন দ্যাখে। সে খেলার কিছু অংশ আটপৌরে, কিছুটা সম্পূর্ণ মৌলিক, আর কিছুটা ব্যাখ্যাতীত। স্বপ্ন একটা মজা, অদ্ভুতুড়ে বিষয়। মৌলিক আর ব্যাখ্যাতীত অংশগুলো মানুষকে ভাবিয়েছে আর ভাবাচ্ছে এখনো।

এমনকি এর  আটপৌরে অংশটাও কম মজার নয় ।

ধরা যাক কেও স্বপ্ন দেখছেন নিজের গায়ে আগুন লেগে যাবার। প্রচন্ড উত্তাপ তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে ব্যাপারটা বাস্তবে হয়তো তার শরীরের কোন অংশ বা গোটা শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়ে গেছে সামান্য ।তাই এই 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো' টাইপ বিরোধীদলীয় স্বপ্ন । আমাদের দেশের গরমের দিন রাতে লোডশেডিং এর ভালো উদাহরন। এক্ষেত্রে  ঘুমিয়ে থাকা বাছাধনরা যে প্রতিনিয়ত অগ্নুৎপাত দেখে না তা তাদের সৌভাগ্য ।

আরেকটা স্বপ্নাংশ অনেকে প্রায়ই দেখেন, যেকোন স্বপ্নের  কোন এক পর্যায়ে কোন উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যেতে থাকেন বা তলিয়ে যাবার মতো অনুভূতি ঘিরে ধরে তাদের। না ভয় নেই, আপনার বিছানা হুট করে রেলিং ছাড়া ছাদ হয়ে যায় নি। আর মহাসমুদ্রের লোনা পানি ছোটোবেলায় অনেকে বিছানায় ঢাললেও  আপাতত বিছানা অতল জলাধার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। এর অতি বাস্তব ব্যাখ্যা হলো মাথা বালিশ থকে পড়ে উচ্চতার তারতম্য হলে এ ধরনের স্বপ্নাংশ এসে অদ্ভুত স্বপ্নের জগতকে আরও একটু আবছা করে দেয়।

অনেক স্বপ্ন আমরা টের পাই না। বলা হয় অধিকাংশ স্বপ্নের গতি এতো দ্রুত যে আমাদের অস্তিত্ব এর নাগাল পায় না। ওগুলো চলচ্চিত্রের দ্রুত টানা ছবির মতো আমাদের মগজে ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে যায়। গভীর ঘুমের স্বপ্নই আমরা কেবল মনে রাখি। বিশাল কোন স্বপ্ন যাতে অনেক চরিত্র আর অনেক ঘটনার সন্নিবেশ থাকে তা আমরা কয়েক সেকেন্ডে দেখে ফেলি। সময় স্বপ্নের জগতে আপেক্ষিক ,অনেক ধীর। টাইম ডাইলুশনের এ আপাত অত্যাধুনিক তত্ত্ব কিন্তু অতি প্রাচীন।

বাস্তবতা আর স্বপ্নের সীমারেখা কোথায় তা আসলে বলা যায় না। এমনকি আপনার এতো সাধের জীবনও একটা দীর্ঘ স্বপ্ন যে না তার প্রমান কি? অনেকের মাথায় ম্যাট্রিক্স সিনেমার কথা চলে আসবে জানি বা এলিস ইন দ্য ওন্ডারল্যান্ড। কিন্তু বাস্তব আর স্বপ্নের পার্থক্য নিয়ে মানুষের চিন্তা কতো প্রাচীন তা জানলে আসলে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হয়। আর মজার ব্যাপার এই Reality বা বাস্তবের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের শুরু আমাদের ভারতবর্ষেই ।

গল্পটা মহাভারতের।
এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ স্নান করতে গিয়েছেন দিঘিতে। মাথায় নানা সংসারচিন্তা, দ্রুত স্নান শেষ করে বাড়ী ফিরবেন তাই ইচ্ছা। দিঘিতে নেমে ডুব দিলেন। আবার জলের উপর মাথা তুলতেই দেখলেন এক পরমা সুন্দরী সালংকারা রমনী্র প্রতিবিম্ব দিঘির জলে। আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে না পেয়ে নিজের দিকে তাকাতেই ব্রাহ্মণ হতভম্ব। তিনিই তো ওই রমনী। তার পরনে বহুমূল্য শাড়ী, গায়ে অলংকার । পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। সে অদ্ভুত দেশের অকৃতদার  রাজা সে দিঘির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে রমনীকে দেখেই তার রানী করে নিতে চাইলেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়েও গেলো। সে দেশে রমনীরুপী ব্রাহ্মণ এর সুখের সংসার হলো। পুত্র, কন্যা, রাজ্যপাট সবই তার। অতঃপর একদিন, এই রানী এক দুপুরে স্নান করতে নেমেছেন জলে। ডুব দিয়ে উঠতেই খেয়াল করলেন জলে এক বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে। এক ডুবে এক জীবন পার করলেন ব্রাহ্মণ । কয়েক মুহূর্ত পার হয়েছে এপারের বাস্তবতায়। ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে গেলেন। কিন্তু তার মন কেমন করছিলো ওপারের বাস্তবতার সন্তানদের জন্য। এপারের বাস্তবতা ওপারের স্বপ্ন। কোনটা বেশি বাস্তব?

এ অতি প্রাচীন গল্পে কি কি জিনিস এসেছে খেয়াল করলে অবাক লাগে।  টাউম ডাইলুশন, প্যারালাল ইউনিভার্স এর মতো থিওরি কিন্তু এ গল্পে আশ্রয় নিয়েছে খুব সহজে।

 স্বপ্নে আমাদের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির ব্যবহার ও বেশ চমকপ্রদ। আমরা চেতন অবস্থায় যে অতি সামান্য গুরুত্বহীন  জিনিসগুলো ভুলে যাই স্বপ্নে আমাদের মন সেগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেয়। স্বপ্নে আমাদের যে অবস্থাটা হয় তাকে সাইকোলজির গুরুদেব ফ্রয়েড বলতেন 'Hypermnesic  State' অর্থাৎ আমাদের স্মৃতি অতি প্রখর হয়ে ওঠে। অতি খুটিনাটি আমরা অতি সহজে মনে করতে পারি যা চেতন অবস্থায় আমরা কিছুতেই মনে রাখতে চেষ্টা করি না, চেষ্টা করলেও পারবো না। অনেকেই ভাবছে ওঁ মধু ! তাহলে স্বপ্নে পরীক্ষা দিতে পারলে কি ভালই না হতো। দুঃখের কথা আমাদের মন আমাদের মতো এতো বেরসিক না যে বিদঘুটে ল্যাটিন নাম মনে করবে। বরং স্বপ্ন আমাদের মনে করায় অকিঞ্চিৎকর ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো । স্বপ্নে আমরা ছোট ছোট ঘটনা আর জিনিসের সম্মেলন দেখি। বহু আগে দেখা কোন রমনীর গ্রীবার সৌন্দর্য, রাস্তা দিয়ে চলা আইসক্রিমওয়ালার চেহারা, ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়া মায়ের শাড়ি।

স্বপ্নে মেরেলিন মনরোর গালের তিল বা শারলিজ থেরনের জড়ানো বহুবোধক মুখভঙ্গি ফার্মাকোলজির স্যার কি বলেছিলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । স্বপ্নে সেটাই বারবার আসবে তাই স্বাভাবিক।(এটা ব্যক্তিগত!)

আর স্বপ্নই বোধকরি আমাদের শৈশবে ফেরাতে পারে। অনেকেই আছেন স্বপ্নে কিছু জায়গা বা মানুষ দেখেন। তাদের মনে হয় সে জায়গায় তারা কখনো যান নি, সে মানুষদের তারা চেনেন না। মজার ব্যাপার স্বপ্ন আমাদের অতি প্রাচীন ভুলে যাওয়া স্মৃতি তুলে আনে মনের গহীন থেকে। আসলে সে জায়গাগুলো বা মানুষরা সদূর শৈশবের স্মৃতিতে আছে। আমাদের চেতন মন যাদের বহু আগে ভুলে গেছে। স্বপ্নে মানুষ শিশুর মতো সরল হয়ে ওঠে । তার উইশফুল থিঙ্কিংগুলো তার দমিত ইচ্ছে যা চেতনার যুক্তিতে সে আবদ্ধ করেছে, সেগুলো আকাশে উড়ে যেতে চায়। স্বপ্নে মানুষ তার ইচ্ছেপূরন করে। সেক্ষেত্রে বলতে হয় আমরা শিশুর মতো স্বপ্ন দেখি। যুক্তির গাঁথুনিতে নয়, স্বপ্ন দাঁড়িয়ে থাকে আবেগ আর ইচ্ছের বালুচরে।

স্বপ্নের কিছু মৌলিক দিক আছে যা প্রতিটা মানুষের জন্য আলাদা। অনেক সময় একি জায়গা বা একি মানুষ আমরা স্বপ্নে বারবার দেখি। সেগুলো আসলে এক ধরনের প্রতীক। আমাদের অচেতন মন অবচেতনের জানলায় চেতনার সাথে কথা বলতে চায় সেসব প্রতীকে। অধিকাংশ সময়ে আমরা তা ধরতে পারি না। প্রতিটা মানুষের অস্তিত্বের গভীরে অসংখ্য বন্ধ দরজা থাকে। সে বন্ধ দরজার ওপারে অন্ধকার খেলা করে। আমাদের আপন আধার। সেসব অন্ধকার সত্যকে আমরা নিজেরাই সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। শৈশবের ভয়, আতংকের স্মৃতি, মর্মন্তুদ কষ্ট আমরা লুকিয়ে রাখি সেসব স্মৃতির ঘরে। স্বপ্নে আমাদের যুক্তির বেড়াভাঙ্গা শিশু সেসব অন্ধকার ঘরের দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিয়ে নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পায়। সে ভয় প্রতিটা মানুষের জন্য মৌলিক। অতি সামান্য কিছু জিনিসে অবচেতন মনে যে ঝড় শুরু হয় তার ধাক্কা লাগে আমাদের চেতনায়। আমরা অবাক হই।

আর শেষমেশ বলতে হয় স্বপ্নের ব্যাখ্যাতীত দিকটার কথা । ফ্রয়েড এর ভাবশিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইউং তার স্বপ্ন নিয়ে করা অনেক কাজ প্রকাশ করেন নি। সাইকোলজির এই জায়ান্টও কিছুতেই অনেক স্বপ্নের অতি আশ্চর্য দিক ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেন নি। অবচেতন মনের এই রাশিয়ান রুলেতের রহস্যে হেরে যেতে হয়েছে সমস্ত বাস্তবতার ব্যাখ্যাকে। কিছু স্বপ্ন মানুষের ধরাছোয়ার বাইরে, যুক্তির অধিক।

স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভালোলাগার মূল কারন স্বপ্ন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কতো ঠুনকো এক জগতে বাস করি। বিভূতিভূষণের মতো আমারো মনে হয় যে দৃশ্যমান জগতের ভেতরে কোথাও আরও জগত আছে।এপারের পর্দার  আপাতবাস্তবতা ছিড়ে ফেললেই যেন ওপারের নাটক আমাদের চোখে আসবে। আর স্বপ্ন আমাদের বোঝায় মানুষ প্রানী হিসেবে কতোটা পরিণত আর অদ্ভুত।  স্বপ্নে দেখা যায় আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা। তার নিউরনে নিউরনে কতো কিছু লুকিয়ে রাখা আছে সযত্নে। মস্তিষ্ক কিছুই হারায় না। আমাদের চেতন মন হয়তো সমস্ত কিছুর নাগাল পায় না । কিন্তু স্বপ্নবাজ অবচেতন সবকিছু খেয়াল করে আর মনেও রাখে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের The  Interpretation of Dreams বইয়ের একটা কথা দিয়েই শেষ করছিঃ

" Nothing that our minds once possessed can ever be lost"

চাইলেও আমরা সত্যিকারভাবে  কিছু ভুলে যেতে পারি না, সেটা সম্ভব না। তা সে কোন অতি গুরুত্ববহ কোন মানুষই হোক বা তুচ্ছ কোন বস্তু।  কারন আমরা স্বপ্ন দেখি।

তথ্যসূত্রঃ
1.The Interpretation of Dreams- Sigmund Freud
2.MIT Research News
3. A general Introduction to Psychoanalysis- Sigmund Freud










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন