লোকটার মানসিক সমস্যা হয়েছে। সারাদিন সে নাকে তুলো দিয়ে বসে থাকে। তুলোয় মেশানো থাকে খাঁটি সৌদি আতর। তাকে যা সৌদির রাষ্ট্রদূত নিজে এনে দিতো নিয়মিত। মাঝে মাঝে লোকটা ক্রমাগত সাবান পানি দিয়ে নাক মুখ ধোয়। সাবানটাও ভালো। পাকিস্তানি সাবান। একসময় উপহার পাওয়া যেত, এখন কিনতে হয়।
কিন্তু কিছুতেই লোকটা গন্ধটা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। কি এক অভিশপ্ত গন্ধ! কি এক অভিশপ্ত জীবন!
তাকে প্রায়ই উঁচু গলায় ডাকতে দেখা যেতো কদিন আগেও। বাড়ির চাকর বাকরদের ডাকছেন "এ্যাই! এ্যাই! আমার বাড়িতে বিড়ি ফুঁকে কোন হারামজাদা! কমজাত! বাদিবাচ্চার দল! গদি নাই তো কি হইছে, এখনো আমার ক্ষমতা জানোস! খুন কইরা পুইতা ফেলবো সবকয়টারে!" ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাকর বাকরেরাও বুঝে গেছে এসব বেহুদা চিল্লাচিল্লি। এই অভিশপ্ত প্রায় আধা পাগল বুড়োর কোন শক্তি নেই। শক্তি সহজ জিনিস না। এই যে সামান্য তামাকের গন্ধে বুড়ো ভয় পায়। অথচ কেও কেও নাকি এদেশে ছিলো যারা বারুদের গন্ধকেও বুক দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিলো। এখন অবশ্য নেই।
বুড়োকে মাঝে মাঝে দেখা যায় ঝকঝকে সাজে। পাঞ্জাবি পায়জামা কিস্তি টুপি। এ সাজে অবশ্য তাকে দেখতে লাগে সার্কাসের বাদরের মতো। সেই আগের বাদরটার মতো।যে বাদরের ইংরেজি ডুগডুগিতে উপমহাদেশ ভেঙে গেলো সেও তো একটা লম্বা টুপি পরতো। আগের সেই ফালতু দেশের টাকায় টাকায় থাকতো সেই বাদরের কিস্তিটুপি পড়া ছবি। এখন অবশ্য নেই। এখন টাকায় শুধু মসজিদের ছবি। বক-ধার্মিক এক জাতি আবার গড়ে উঠছে। বাদরেরা শকুনেরা হায়েনারা মানুষের মতো হাসছে এখনো। তবু এই সফেদ বাদরের মতো বুড়োর মনে শান্তি নেই।
সে চোখ বন্ধ করলেই দেখে কাওকে কাওকে। বিশাল কেও একজন। ব্যাকব্রাশ করা চুলে যাকে মনে হতো রুপকথার চরিত্র। বুড়ো ঘুমোয় না। তবে মাঝে মাঝে একটা গন্ধ খুব বিরক্ত করে দিনে রাতে সবমসময়। তামাকের গন্ধ। খুব পরিচিত একটা তামাকের গন্ধ। মনে হয় এইমাত্র কেও পাইপ সাজিয়ে প্রথম আগুনের আঁচ নিয়ে সুখটান দিলো। তামাকটা দামি। এলান মোর না কি যেন? লোকটা পাইপ খেত খুব। পাইপ থেকে বেরুনো মিষ্টি-কটু গন্ধে ম ম করতো চারপাশ।
মাঝে মাঝে বুড়োর ভয় বাড়ে এই বুঝি সেই তামাকগন্ধা বিশাল হাতটা এসে পড়ে কাধের উপর। কেও একজন তার মেঘের মতো গাঢ় গভীর স্বরে ডেকে উঠে তার নাম। ভয়ে অস্থির লাগে। সে ডাকাডাকি শুরু করে। আতরে সাবানে সে তামাকের গন্ধ আটকায় না। মনে হয় পাশে বসে তার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে নিশব্দে পাইপ খাচ্ছে কেও! এটা কোন কথা!
বুড়োর চাকর আহমেদের বয়স বেশি না। গ্রামের ছেলে। নিরক্ষর, জানে না সে কিছুই। তবু সে হালকা হালকা আঁচ পায়। বুড়ো একটা বড় পাপ করেছে এককালে। সে কারনে এই অভিশাপগ্রস্ত অবস্থা। রক্তে চুবে উঠেছে বুড়োর রাত্রিদিন। আহমেদ তামাকের গন্ধ পায় নি কোনকালে। তার খুব শখ যে লোকটা তামাক খায় তাকে বাস্তবে দেখার। তার পুরোনো ট্রাংকের তলায় খুব গভীরে লোকটার একটা ছবি লুকিয়ে রাখা আছে। তার বাবা একটা যুদ্ধ করেছিলো তো!তাই তাদের কাছে এখনো এসব ছবি লুকোনো থাকে।
এ দেশে এখন ওসব মহাকায় লোকের ছবি রাখা বারণ। এখন দেয়ালে দেয়ালে ঝোলে উর্দি পড়া ছোট ছোট বাদরের মতো মানুষ। হাস্যকর লাগে তাদের দেখতে।
অভিশপ্ত বুড়ো একদিন মারা যায়।
কিন্তু দেশে আর সুদিন আসে না। আহমেদ বুড়ো হয় একদিন। বুড়ো হবার পর সে শুধু আতরের গন্ধ পায়, পায় সাবানের গন্ধ। সে অবশ্য চিৎকার করে না। সে জানে এই গন্ধ বাস্তব। এইতো গাড়ি দিয়ে গেলো একজন। ফোনে কথা বলতে বলতে একজন। তাদের সবার গা থেকেই আসছে। একদল লোক একটি লোকের সাথে হাত মেলাচ্ছে। তার গা থেকে ভুরভুর করে আসছে সৌদি আতরের সেই পুরানো ঘ্রাণ।
এই লোকগুলোর গায়ে আর এই নষ্ট রাজধানীর রাস্তা ঘাট পার্ক আর অভিজাত অঞ্চল জুড়ে সেই বুড়োর আতরের গন্ধ। দেশের আনাচে কানাচে অনেকগুলো লোক মহাকায় মানুষটার মতো সাজে। তাদের দেখতে লাগে হাস্যকর। লিলিপুট যেন সাজতে চায় গালিভার। তাদের গা থেকে বের হয় পাকিস্তানি সাবানের সেই গন্ধ। আহমেদ টের পায়। তার বয়স হয়েছে। তার টের পাওয়া উচিত।
সে রাস্তায় দেখে মহাকায় মানুষটাকে লোকজন ছোট্ট করে ব্যানারে ফেস্টুনে বন্দি করার খুব চেষ্টা করছে। কালো রঙ দিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে সাজাচ্ছে চারপাশ! যেসব লোকের মনেই নেই লোকটা কে, শুধু প্রতীকের মতো একপাশে রাখতে হয় বলে তারা রাখে মানু্ষটাকে। তাদের ছবিগুলোই এখন আকারে বড়ো। আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। সাবানের গন্ধ পাওয়া যায় এসব ব্যানার ফেস্টুন থেকে। আহমেদ পায়। সে হাঁটে রাস্তাঘাট, বন্দর,অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ ও প্রান্তর। কোথাও লোকটার কোন অস্তিত্ব নেই। সাবান আর আতরের গন্ধ পাওয়া যায় কেবল। বুড়োটার গন্ধ।
মহাকায় লোকটার ছবি সর্বত্র। সব দেয়ালে ঝুলছে তার ছবি। অথচ ওরা তাকে বন্দি করতে পারে নি সেসব সামান্য ফ্রেমে। কবেই লোকটা এদেশের বিশাল আকাশে মিশে গেছে।
শ্রাবণ শেষ হয়ে গেলেও ঝুরঝুর করে কাঁদে লোকটা।সে কান্না বৃষ্টির মতো হয়েই নামে। মানুষকে বিশ্বাস করে কষ্ট পাবার মতো বেদনা যে আর নেই! পাথরের মতো মানুষটা বুক ফাটা আর্তনাদ করে ওঠে মাঝে মাঝে। মেঘের ডাকে সে আওয়াজ সবাই টের পায় না। আহমেদ টের পায়।
সে টের পায় এ দেশে এখন সব জায়গায় মহাকায় লোকটার ছবি। কিন্তু মানুষটা আসলে নেই। সে নেই কারণ, ব্যানারে ব্যানারে, ফেস্টুনে, তোরণে, তার ছবি থাকলেও কারো বুকের ভেতরে তার জন্য সামান্য যায়গাও এখন নেই। এখন সবাই চায় কিস্তি টুপি পড়ে হলেও চেয়ারে বসতে। দু চার কথা বলতে। নষ্টদের হৃদয়ে মহাকায় মানুষটা থাকতে পারে না। তারা মরসিয়া কাঁদে আজকাল। লাফিয়ে লাফিয়ে খ্যাক খ্যাক করে আড়ালে হেসে সামনে কেঁদে প্রকাশ করে শোক। কি নোংরা তাদের হৃদয়!
এরকম এক নোংরা শোকসভায় গিয়েছিলো আহমেদ একদিন। সেখানে হচ্ছিলো দল উপদলের রাজনীতি। তার দমবন্ধ লাগছিলো। সে পাচ্ছিলো তীব্র আতরের গন্ধ। সে পালিয়েছিলো ওখান থেকে।
আহমেদ বুড়ো হয়ে গেছে। শক্তি কমে আসছে প্রতিদিন। তবু তার টের পাওয়া কমে না।সে টের পায়, দেশটা কেবল ভরে উঠছে সাবান আর আতর মাখা বুড়ো মোশতাকে। তাদের জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন।শেখ মুজিব নামের মহাকায় লোকটাকে বহুকাল আগে আসলেই ঠিকমতো খুন করা হয়েছে। মেরে ফেলা গেছে সমস্ত তামাকগন্ধা হৃদয়।সবার ভেতরে এখন রক্তে চুবানো আতরের সুবাস।
এখন বাতাসে কেবল আতর আর সাবানের পবিত্র ধর্মীয় গন্ধ গাঢ় হয়ে উঠছে। মোশতাকের সংখ্যা বাড়ছে। আর মুজিব? মহাকায় শেখ মুজিব এসব শোকসভায় আসলেই মরে গেছে। তামাকের গন্ধটা এজন্যই কোথাও নেই। কোনদিন পাওয়া যাবে না আর কখনো!