শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫

সপ্তপদী

এসো, এবার গোল হয়ে বোসো।
মনের দু:খ জ্বালাও ঠোটের ভাজে,
পাত্তরের বুক ঘুরে আসুক সোমরস
ক্ষমাহীন আঘ্রাণের এ মাতাল চাঁদে।

আকাশের অকথ্য কষ্ট মরুক চুপচাপ ডুবে
সাথে নিয়ে সপ্তপদীর পায়ে জমা জন্মান্ধ বেদনা
মনের অন্ধগলির বাঁকে নীল, আজ নির্ভুল জোছনা! 

বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫

আত্মসমর্পণ

ভীত হরিণ শাবকের মতো একটা রাস্তা ধরি
পেছনে তাকাই না আর, সামনেও দেখি না
পেছনের পথটুকু মাখা মরা শিউলির গন্ধ
আর সামনে চৈত্রের করাল খাণ্ডবদাহন
তাই হোঁচট খাই আর স্বপ্ন দেখি,
তোমাদের দেখি না।

তোমাদের দেখলে আসলে বড়ো ভয় পাই
কত নিশ্চিন্ত হয়ে  হাটো, হাত-পা নাড়ো।
কি চমৎকার বলে ফেলো, 'ভালোবাসি'!
আর আমি,শব্দটার মানে খুঁজতে পথে নেমে,
 হনহন করে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি।

মনের কোমল কোঠরের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে
সমস্ত আলোচনা শেষে, সই করি আত্মসমর্পণ।
দু:খের দাগটা মুছে ফেলি,করুণ আঙুলে।

শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৫

সস্তা হোটেলে মধ্যাহ্নভোজ

কয়েকটা টেবিল ইতস্তত বসে, বিচ্ছিন্ন প্রণয়ীর মতো
হঠাৎ দেখা হবার কুন্ঠা নিয়ে, আপাতত লজ্জিত।
চেয়ারেরা যেন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদলের পুনর্মিলন,
যেখানে পুরোনো ভাগের সিগারেট স্বাদটা আর নেই।

প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের মতো লাল সস্তা বোকা জগটা
অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে, ডাকলেই ফিরবে না আর।
লোহা রং লাগা মলিন গ্লাসগুলো পচে গেছে
ভালোবাসাহীন ঠুনকো সম্পর্ক ছুঁয়েছে ওদের বুক।

সুখ আসলে এক থালা ধোয়া ওঠা গরম ভাত, পাইনি।
ঠাণ্ডা ভাতের জীবনে দু:খের ঝোলটুকু মেখে খেয়ে নেই।
কড়া রোদের মতো ঝালে,পোড়া চোখে জল আসে
আসলে কেউ তো বলার নেই, "আর দুটো ভাত দেই?"

প্যালিওলিথিক স্বপ্ন

 খানিকটা আকাশ অন্ধগলির চোখে চুপ,
গনিকার আদরের মতো পবিত্র এ সকালে।
পীচরাস্তার ছটফটানিতে, ইচ্ছে হয়  
 আবার প্যালিওলিথিক যুগে ফিরে যাই।

এ শহরে অরণ্য নেমে আসুক,  
প্রতি পদক্ষেপে জন্ম নিক, হিংস্র সব শ্বাপদ।
অন্তরে ঘিরে সবুজাভ আধারীর ভয়
আর অনিশ্চিত প্রশ্বাস থাকুক, আমাদের বুকে।

আর একবার ফিরে যাই, আমরা ভয়ের কাছে,
যে ভয় আমাদের আচ্ছাদন, আমাদের আশ্রয়।
মরে যাবার ভয় নেই বলে, বাঁচতে শিখি নি
ছোটার তাড়া না থাকায়, কেবলই ভুল পথ
গোড়ালির নিচে জমে যায় আর থামে।

পরস্ত্রীর গন্ধের মতো আগুন লাগা সন্ধ্যা,
রক্তাভ হয়ে কার্তিকের নীলে গিয়ে মেশে।
রং, আমাদের অবাক না করে আর,
নিয়ন আলো জ্বালিয়ে দু'চোখে
কবোষ্ণ মাংসপিণ্ড মাপতে বসি আবার।  

এ নিষিদ্ধ শহরে কবরের মাছিরা ওড়ে,
লালাভ রক্ত গালে মেখে পরীরা নেমে আসে
কোমল আধারে। আমরা সে পরীর ডানা ছুয়ে
পবিত্র হবার পরেও নষ্ট হতে ভয় পাই।

রাত্রির সাথে প্রণয়কলহ  তুমুল হলে,
আকাশে জাগে কৃষ্ণা অষ্টমীর ভীত চাদ।
আমরা আধো ঘুমে মানুষীর স্বপ্ন দেখি,
কবিতার মত নষ্ট সব স্বপ্ন, গদ্যের অক্ষরে।

স্বপ্ন আমাদের টানে, কাঁটার উজানস্রোতে
করুনায় আদ্র সব গোলকে আমরা ডুবে যাই
আমরা তীব্র হই ভাদ্রের লুব্ধকের মত মেতে।

আমাদের আক্রান্ত শরীরের চক্রান্ত ঘুমুলে,
আমরা স্বপ্ন ভেঙ্গে সভ্য হই, দুপুরে সকালে
ঈশ্বরের পৃথিবীতে ডুবন্ত আলোড়ন তুলে।

সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫

গুরুচণ্ডালী (পাদুকার প্রত্যাবর্তন )

বহুকাল পরে( তা মাসখানেক তো হইবেই) যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম তখন রীতিমত সাড়া পড়িয়া গেলো। মাতা ও ভগ্নীরা দহলিজের বাহির হইতেই আপাদমস্তক জরিপ করিতে লাগিলেন। মস্তকের ইস্ক্রুপ ঘটিত সমস্যাদি তাহারা জানিতেন বলিয়া খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না। তবে পদদ্বয় দেখিয়া মাতা ফুকারিয়া কাদিয়া উঠিলেন আর ভগ্নীদের মুখও চুন হইয়া গেলো।  কারনটি সামান্যই, পায়ে একজোড়া নিন্মবর্গীয় পাদুকা।

ঘটনাখানি এরুপ, মাতা ইতিপূর্বে অর্থাদি প্রেরন করিয়া বারংবার একজোড়া সুদৃশ্য পাদুকা ক্রয় করিয়া এ পুত্রকে নিজের পদোন্নতি করিতে আজ্ঞা করিয়াছিলেন। আমি কুপুত্র তাহা নয়ে ছয়ে চুয়ান্ন করিয়া ফেলিয়াছি। এদিকে কত রাম ,শ্যাম ,রহিম, করিম, যে বহুমূল্য পাদুকা পড়িয়া মসমসাইয়া চলিয়া পটপটাইয়া কথা কহিয়া দুনিয়া ভাজিয়া খাইলো তাহা বলিতে বাকি রাখিলেন না।বুঝিলাম, মস্তক যে চুলোতেই যাক উহাদের পদোন্নতি হইতেছে এবং হইবে। এদিকে তাহার 'লাল' ই কেবল মুখচোরা রহিল গো! রাজ্যের পুঁথি পড়িয়া  ইহার মস্তক বিগড়াইয়াছে। মস্তক ছাড়িয়া পদের যে কিছু করিবেন তাহাও দুরাশা। যে বাহ্যে যাবার নিচুজাত পাদুকা পড়িয়া ভ্রমনে বাহির হয় তাহার জীবনের আশায় ঢ্যারা পড়িয়াছে ইহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

ইত্যবসরেই আমি যে কিরুপ কালকাশ  সদৃশ রোগা হইয়া গিয়াছি এবং আমার গৌরবর্ণ (!)  রং কিরুপ পুড়িয়া গিয়াছে উহারা তাহা লইয়া পড়িলেন। একদিকে আমি ভীমের মত খাইয়া আর কুম্ভকর্ণ এর ন্যায় নিদ্রায় স্ফীতোদর হইয়াছি। অন্যদিকে জন্মান্তেই যে কয়লাকান্তি রুপ লইয়া জন্মিয়াছি তাহারও কোনরুপ ক্ষয় হয় নাই। মনে মনে কহিলাম "আমি কালো হইয়া যাই নাই, কালো থাকিয়া গিয়াছি, এই যা।"ইহাতে এরুপ কোলাহলের কি আছে! বুঝিতে না পারিয়া মৌন হইলাম।

কেবল নিজের কথাই বলিতে এই খটমটে গুরুচন্ডালী খুলিয়া বসি নাই তাহা বলিলে মিথ্যাচার হইবে। এ আমার একান্ত নিজস্ব কথন।  ভালো না লাগিলে দূরে গিয়া মুড়ি ভক্ষন করিলেই খুশি হইবো।

এইবারের যাত্রাখানা বড় অম্লমধুর ছিলো সে ব্যাপারে সন্দেহ নাই। প্রথমত,  শ্যালকের পুত্ররা লিখিত পরীক্ষায় নানা রকম ফ্যাকড়া বাধাইয়াছিলো। সময়সূচী দেখিলেই উহাদের খুরে প্রনাম জানাইতে হয়। দিতীয়ত পেশাগত পরীক্ষায় নানা পেশা অবলম্বন করিতে হয় (চৌর্যবৃত্তি, নকলনবিশি ইত্যাদি)। এই মহাসত্য জানিয়াও  দুই শশ্রুমন্ডিত বারবনিতার পুত্র আমাদের মহাযজ্ঞে বাগড়া দিয়াছিলো। তাহাদের বিচার ঈশ্বর করিবেন। গায়েবী ও পার্শ্বীয় সহযোগীতায় গোটা চারেক কুম্ভীপাক পার হইলাম।

তবে সর্বশেষ পরীক্ষায় সে এক পরিস্থিতিরই উদ্ভব হইলো। আজও গা শিহরিয়া উঠিতেছে। পূর্বদিনে প্রশ্নপত্র আগমনীর বাজনা উঠিলো বাজি। সে বাদ্যে আনপড় নাচুনে বুড়ো বুড়িরা ঝাপাইয়া পড়িয়া 'নাচমেঝে' কাপাইয়া দিলো। আমার কক্ষবন্ধু  'মহাধিনায়ক নিধিরাম' অগ্নিতে নুন ঘৃত দিয়া জনতার উল্লাসকে  উৎসবে পরিনত করিয়া দিলো। আরেক কক্ষবন্ধু 'কুম্ভকর্ণ' দিবারাত্র দক্ষিণী ছায়াছবি দেখিয়া আর নিদ্রা যাইয়া সকলের অধ্যয়নাদি দু:সাধ্য করিয়া তুলিলো।

তাতে অবশ্য লাভ বিশেষ হইলো না।

রাত্রির শেষ প্রহরে মহাধিনায়ক  মুঠোফুন মারিতেই প্রশ্নবাবা কহিলেন " খোকা,প্রশ্ন তো  বাঘ শিকারে সুন্দরবন গিয়াছে। ফিরিলে সাক্ষাৎ হইবে।"

মহাধিনায়ক শিরে আঘাত করিয়া ক্ষীন আওয়াজে কহিলো "হইলো না" ইহার পর বিভীষনজাত সহপাঠিনীকুল আর প্রশ্নবাবার প্রতি যেসব 'মধুর' বাক্য প্রয়োগ করিলো তাহা সে কলাপ মুগ্ধবোধে শেখে নাই তাহা বলাই বাহুল্য।

নিদ্রিত  ছাত্রজনতা জাগ্রত হইয়া হু হুংকারে কাদিয়া উঠিল, 'হায়! তাহারা কি এই দেশ চাহিয়াছিলো। যে দেশে সামান্য প্রশ্নফাঁস এর নিশ্চয়তা নাই সে দেশের হইবে কি!"

 যাহাই হোক বিভিন্ন পেছনের দরজা ব্যবহার করিয়া প্রথম পরীক্ষার মুখাগ্নি আর শেষখানার পশ্চাৎ ছারখার করিয়াই  বাহির হইলাম।

মুক্তকেশ হইয়া স্বগৃহে ফিরিব। আমার  বন্ধুবর , যিনি এ মহাবিদ্যালয়ের অন্যতম 'উর্বশীর অভিশপ্ত অর্জুন', তিনিই যাত্রার ব্যবস্থা করিলেন। পরে জানিলাম , হায়!আমার সর্বনাশ হইয়াছে।ভয়ে প্রান উড়িয়া গেল। এ দেখি 'হংস মধ্যে গুগলি যথা' বিচরন করিতে হইবে। যাহাকে দেখিলে বায়ুস্তরের সমস্ত অম্লজান উড়িয়া যায় বলিয়া মনে হয় তাহার সহিত যাত্রা করা, নৈব চ নৈব চ। কিন্তু ইহার  কারন আজও খুঁজিয়া পাইলাম না।কম তো ভুগাইলো না।মগজকে প্রশ্ন করিলে কহে ''রসো কাকা,অনুসন্ধান চলিতেছে।'' তাইতে আবার সংগী আরেক সহপাঠী 'বিচিত্রবীর্য' । এ দুইয়ে মিলিয়া আমার 'পা টানিয়া' রংগ রহস্যে আর কিছু রাখিবে না। দমাদম মানসিক আছাড় খাইবো।

এদিকে বন্ধুরূপী শত্রু বুরবকদিগকে যাহাই বলি না কেন তাহা লইয়াই ইহারা রঙ্গ করিয়া সারা হয়। আমি উহার প্রেমে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছি এই প্রচারে ইহারা অক্লান্ত।  মনে মনে কহি "প্রেম ফ্রেম হইলে তো বাঁচিয়াই যাইতাম। দর্শনের  লাইফবোট খরিদ করিয়া তীরে আসিয়া প্রেমকে মুখ ভ্যাংচাইতাম।উহা আমি ভালো পারি। যাহা হইয়াছে তাহা পাভলভ, ফ্রয়েডে ব্যাখা করিতে হয়। জ্ঞানও নাই সাহসও হয় না। ব্যাখা করিতে গেলে ঠ্যাঙানী খাইবার সম্ভাবনা অতি উচ্চ। তবে তত্ত্ব যুক্তি শুনিতে ইহারা রাজি না। অঙ্কও বোধহয় কম শিখিয়া থাকিবে।অমুক যোগ তমুক করিতেই ইহাদের উৎসাহ। এ শালারা বিয়োগ জানিলে বড় ভালো হইতো। সব হইতে আমাকে বিয়োগ করিলেই খুশি হইতাম।"

যাহাই হোক এ আকাঁড়া বাজারে কে টিকিট ক্রয় করিবে? আমার  কোন শ্যালক! 'যা থাকে ললাটে' বলিয়া  যাত্রা করিলাম।

উহারা যথাবিহিত যত্নপূর্বক আমার মানসিক দেহের সৎকার করিলেন। মানে যেটুকু অবশিষ্ট রহিল তাহা অকিঞ্চিৎকর। পরে পারাপারের  জলশকটে চড়িয়া নানা কায়দায় নিজস্বী তুলিতে ব্যতিব্যস্ত হইয়া গেলেন। চোখ বুজিয়া আমিও কয়েকটিতে চলিয়া আসিলাম। (ষড়যন্ত্র এর ফল, আর এমনিতেই আমার চৈনিক চক্ষু)।মুখপঞ্জিকায় বিস্তর হাসাহাসি হইল। দেখিয়া দু:খে দার্শনিক হইয়া গেলাম।

যাহাই হোক, শেষমেষ আসিয়া পৌঁছাইলাম শৈশব সমাপ্তির শহর ঢাকায়। যাদুর শহর, যে শহর অদ্ভুত মন্ত্র পড়িয়া আমাকে টুকরা টুকরা করিয়া জীবনপথে ছুড়িয়া ফেলিয়াছে। যে শহরে একটা ছেলে বড়মানুষদের ভীড়ে হারাইয়া ক্রমাগত নিজেকে খোঁজে।তার স্বপ্নগুলো অলিতে গলিতে অন্ধ ভিখিরীর মতোন বস্তবের কাছে হাত পাতে। মাধুকরীর এ জীবন বড় অসহ্য লাগে সময় সময়।

পাদুকার কথায় ফিরিয়া আসিতে হইতেছে। আশৈশব খালি পায়ে দৌড়াইয়া বেড়াইয়াছি। পথে ঘাটে অলিতে গলিতে খেলিয়া ঘুড়ি উড়াইয়া, লাটিম ঘুরাইয়া দিন পার হইয়াছে। হতদরিদ্র সে শৈশব খুব খারাপ ছিল বলিলে মাথায় বজ্রাঘাত হইবে।

শৈশব ছিল বিস্ময়। বনদেবীর আঁচলের তলায় যে শৈশবের শুরু তাতে চিন্তার প্রসারতা ছিলো। সত্যিকার বন্ধুরা ছিলো।তাহারা কে কোথায় হারাইয়া গেলো আর খুঁজিয়াই পাইলাম না।  টাকা- ক্ষমতার লড়াই,ফটকাবাজির ধাধা,  অন্যকে ছোট করিয়া নিজে বড় হইবার প্রাণান্তকর চেষ্টা এসব ছিলো না।কয়েক দিগন্ত ফিরোজা নীল আকাশ ছিলো, মাঝদুপুরে স্কুলপালানো বনঝোপের সবুজ ছিলো। এখনকার অনেক পরিচিতকে দেখিলে নিজের উপরই বিবমিষা জাগে। আমিও বোধকরি ইহাদের মতোই হইয়া গিয়াছি। তবে এটুকু সত্য, যাদের আজকাল বন্ধু বলিয়া জানি তাহাদের অনেকেই মনের সদর দরজাও পার হইতে পারে নাই। অন্তরে প্রবেশের রাস্তাটা কি শৈশবেই বন্ধ হইয়া যায়?

তা না হইলে এর পরের সমস্ত সম্পর্ক কেমন যেন মেকি বোধ হইতে থাকে কেন? কেন আমাদের এ সমাজে, এ অদ্ভুত উটের দেশে মানুষের দাম এতো কম? পরিধেয় কেন ঠিক করে একজন মানুষের প্রতি আরেকজন মানুষের আচরন?

জীবনে প্রশ্নবোধকের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়িতেছে।

মনে করিয়াছিলাম এ খটমটে পাতায় কেবলই রামগরুড় এর সহাস্য কথন থাকিবে। তা আর হইলো কই। এমনিতে কিন্তু আমি হাস্যকর একজন মানুষ। কেনো যেন মনে হয় ঠিকঠাক বড় হইয়া উঠিতে পারি নাই। সেই ছোট্টটিই রহিয়া গেছি।ইংরাজিতে তোমরা যাহাকে বলো 'Adult' বা 'Grown up' তাহা হইতে পারিলাম কই?  চিন্তা সাবালক নহে তাই আচরনও জলের মতো। নির্দিষ্ট আকার নাই।  ব্যক্তিত্ব, আত্মসন্মান, সামাজিকতা, ভদ্রতা এ সমস্ত শব্দের অর্থ এখনো মর্মে  প্রবেশ করে নাই। তাই এখনো কতকটা খাপছাড়া, উল্টো কাছিমের মতো জীবনের আকাশ দেখিয়া বিস্মিত হই। দিগন্তের গায়ে অংশুমালীর যে কিরণ মেঘে মিশিয়া নানা রঙ ফুটাইয়া তুলে তাহা ছানিতে চাই। গগের গমখেতে চুপচাপ ঘুরিতে চাই।

চাহিদার তালিকায় দামী পাদুকাজোড়া ক্রমশ নিন্মগামী হয়।আমার দোষ নাই।

সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০১৫

একটা গল্পের গল্প



গল্পটার তখনো অনেকটা বাকি,
আমরা দুজন চুপচাপ, মুখোমুখি,
ফ্রিজ শটে স্থির।
 ইতস্তত হেলে যাওয়া জানালা
উড়ে যাচ্ছিল, কাকের ডানায়,
উল্টো কাছিমের বালুকাবেলায়।

শুরুটা হলো ছোটগল্পের মতোন,
অবাস্তব সব উপমার ছড়াছড়ি।
আমি মন দিচ্ছি তোমায়,
তুমি উপমায়।

একের পর এক শব্দ কুড়িয়ে
আমাদের গল্প এগোয়।
কথাগুলো ধোঁয়াশার মতো
আস্তে আস্তে জমে উঠে কুয়াশায়।

আনমনে তুষারপাত  কিছুতেই হয় না।
এ দেশে এখনো বৃষ্টি, কালো মেঘ,
সাদা আলোর আচমকা ঝলক,
অন্ধ জাহাজীর অনন্ত অপেক্ষা।

আমাদের স্বপ্নে একটাই তুষারঝড়।
সে জন্য আমরা অপেক্ষা করি
গোটা একটা জীবন।

গল্পের মধ্যমায় পৌঁছে আমরা টের পাই
এখন,অশীল অন্যমনস্কতা আমাদের
এক করে রাখে।
মৃতবৎ সংলাপ সব ঘিরে ধরে বাহুপাশ,
আমরা নির্বাক হই।

গল্প শেষ করার ইচ্ছে আর হয় না।
আমরা ক্রমাগত বাসি হয়ে যাই।
আমাদের শব্দে ভাসে
মাংসপচা গন্ধ।

অথচ  তোমার শব্দগুলো, অজস্র তারা ছিলো
যাদের পথক্লান্ত আলো, মাত্র এলো।
গ্রহ আর গ্রহান্তরের অগ্রন্থিত কাব্য ছিলো
যাদের দূরত্ব, সমস্ত কবিতার ছন্দ
অথচ আমাদের ছিলো অবাক ধুমকেতু প্রেম,
যে বারবার ফিরে আসে
প্রথম কিশোরীর মুখের মতোন।

শেষমেষ আমরাই নষ্ট করে দিলাম সব
আমাদের চারপাশে অগুনতি অনূভুতির শব।
এখন আমাদের অনেক নষ্ট দিয়ে,
অকালমৃত পুতুলের বিয়ে।

অবান্তর কিছু  আওয়াজ
ঘিরে থাকে চারপাশ।

রক্তের রঙ ফিকে হয়ে গেলে
যে প্রদোষে ফুটেছে কদম,
তার মতো মরে যেতে যেতে
আমরা ভালোবাসি। 

মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

ছাইপাঁশে আঁকা ছবি

মন ভালো না লাগা ব্যাধিবিশেষ না হলেও ব্যাধবিশেষ তো অবশ্যই। এ সময়গুলোতে মনের সমস্ত বিষয় একমতভাবে থাকে না। নিজের সাথে নিজের কেমন যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মনের খারাপ এক অংশ খুবলে খায় অন্য অংশগুলোকে। নিজের ভেতরে জারি হয় সামরিক শাসন। একনায়কের মতো 'মন খারাপ মন' শরীর আর মনকে যেদিকে খুশি টেনে নিয়ে যায়। মনের ভেতর কামানের আওয়াজের মতো অনেকের কণ্ঠস্বরের বিহ্বলতা নিজেকে গ্রাস করতে থাকে। ফেলে আসা যায়গাগুলো ট্যাঙ্কের চাকার মতো মনের জমিনে দাগ কাটতে শুরু করে। সদ্যজাত পাখির অশক্ত ডানার মতো মনে হয় নিজেকে।

সারাদিন সারারাত আছন্নতায় কাটে। আবার আরেকটা সকাল শুরু ঠিক কখন হয়ে গেলো বুঝতে পারা যায় না। মনের অলিতে গলিতে যেন মূর্ছনার আসর বসে। ফাঁপা মগজের কোথাও ক্রমাগত রবীশংকরের সেতারের সাথে ম্যানহুইনের বেহালার সুতীব্র সঙ্গত। এ পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ বলে মনে হয়। মানুষ ছাড়া আর সব ভালো লাগে। মানুষদেরকেই কেবল বীভৎস মনে হয়।

মনের আকাশে ছাইরাঙ্গা মেঘ ঢেকে দিয়ে যায় অতীত। নিজেকে আর কিছুতেই চিনতে পারা যায় না। অতীতের পথে ঘন কুয়াশা। নিজেকে দেখা যায় না। কেমন করে সে মানুষটা জন্মে গেলো? কবে ? কবে নিজেকে আলাদা বলে চিনেছে? কতোটা পথ হেঁটে নিজেকে জেনেছে? নাকি কিচ্ছু জানে না এখনো? সে এতো তীব্র নিঃসঙ্গতার বিষে মাতাল কেন? সংঘ ও সঙ্গ এতো অসহ্য মনে হয় কেন?

অতীত প্রাসাদের বহু স্মৃতি কামরায় নিজের লাগানো তালা। চাবি কোথায় হারিয়েছে সেটাও মনে করতে বাধে। মাঝে
মাঝে নিজের ভেতরকার দানবের সাথে কথা হয়। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরের মানুষের সাথে। বন্ধ দরজার ওপারে দাড়িয়ে নিজের দানব আর নিজের মানুষগুলোকে নেড়ে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু দরজাগুলো খোলার সাহস আর হয় না।

অনেক সময় কিসব অবাক অনুভূতির টুকরো এসে আঘাত করে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য নিজেকে ছোয়া যায়। সেই অনুভূতিগুলোই কি আমার অবচেতনের পাঠানো চিঠি কিনা তা আমি জানি না। আর পাঠালেও সে চিঠি কখনো খুলে দেখিনি।

জীবনটাকে নিয়ে কি করা উচিত সেটা কখনোই বুঝতে পারি না, পারবো বলেও মনে হয় না। নিজের ভেতরকার তীব্র মানুষটি, যার সাথে আমার তুমুল সহবাস আদি-অন্ত, তাকে কখোনো ছুঁয়ে দেখা গেলো না। বুঝতে পারা গেলো না।

বাইরের এই খোলসের ভেতরে পোরা অস্তিত্বকে খুঁজে দেখাটা খুব দরকার। সে আসলে কি চায়? কোন প্রশ্নের উত্তর চাই তার? কোন প্রশ্নগুলো সে করতে যায় জগতের উত্তরের প্রতি?
জানাটা ভীষন দরকার, অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

 অন্যকে জানানোর নিজেকে চেনানোর চেয়ে নিজেকে চেনা-জানাটাই ক্রমশ জরুরী হয়ে উঠছে। ভালো লাগা না লাগার যুগলবন্দীর এ অপার্থিব জীবন কেন তার উত্তরের কিয়দাংশের কিছুটা জানা গেলেও বেশ হতো।


দেখানোর আসলে কিছু নেই। নেই আরোপিত উদাসীনতার কোন মানে। নিজের মনের ঝড়ের নবম সংকেত
আসলে কারো বন্দরেই পৌঁছোয় না। নিজের দুঃখের ঢেউগুলো চিরে ফেলে নিজেকেই এগুতে হয়। একাই অশক্ত হাতে ধরতে হয় শক্ত হাল। ঝড়ের পর ঝড় পেড়িয়ে একা অভিশপ্ত  জাহাজীর মতো টেনে নেয়া জীবন। একাই শেষ করতে চাই সব।লগবুকে কিচ্ছু থাকবে না। অজস্র গল্প জমা বুক নিয়ে চুপচাপ বন্দরে পৌঁছুবো একদিন।কাওকে কিছু না বলে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেব। কেও না জানলো আমার গল্প। সাগরের পাড়ে চুপ করে বসে দেখবো কতোটা পেরিয়ে এলাম। কি অদ্ভূতুড়ে ছিলো আমার নেশাতুর একাকীত্বের জীবন। শেষমেষ একদিন সাগরের বুকে ঝরে পড়া অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটার একটার মতো ঝরে যাবো এই পার্থিব জগতের অপার্থিবতার মেঘের বুক থেকে। ভেসে বেড়ানোর খেলা শেষে অকিঞ্চিৎকর জীবন শেষ হয়ে মিশে যাবে থমকে থেকেও উত্তাল জীবনের মহাসমুদ্রের জলে।