ক্যান্টিনের
সামনের কামিনী গাছটা এলোচুলো চঞ্চল কিশোরীর মতো কাল সারারাত বড্ড ভিজেছে।সারা রাত
বর্ষণ শেষের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এখন ঝাঁকড়া পাতার চুল থেকে টুপটাপ জল ঝেড়ে
ফেলছে।সারা রাত ঝরে যাওয়া আকাশ যেন এই অদ্ভুত জীবন্ত গ্রহের উপর মটকা মেরে পরে
আছে।আকাশের গায়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন এক ধরনের নরম সাদা রঙ।
আমার
একহাতে একখানা উষ্ণ চায়ের কাপ। আরেক হাতে দিনের প্রথম সিগারেট। চারপাশের সমস্ত
গাছের পাতা টিয়ার পালকের সজীবতার ভেজা সবুজ। শিবরঞ্জনীর কোমল গান্ধারের মতো বিষন্ন সুন্দর
সকাল।
ভোরে
ঘুম ভাঙ্গার পর খেয়াল করলাম বৃষ্টি শেষের আরামদায়ক ঠান্ডা। কাঁথা মুড়ি দিয়ে
ঘুমানোটাই বোধহয় স্বাভাবিক কাজ ছিলো। কিন্তু কেন যেন উঠেই পড়লাম।ইলেক্ট্রিসিটি
আছে, ভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণত, এ শহরে ঝড় বৃষ্টির আগে অবশ্যম্ভাবীভাবে বিদ্যুৎ
হাওয়া হয়ে যায়, আর আকাশ ঝলমলে সুন্দর হওয়ার আগে আর ফেরত আসে না।
হাত
মুখ ধুয়ে এসে ইলেক্ট্রিক কেটলীটায় জল চাপালাম।গতরাতে পড়ার চেষ্টা করা বইগুলো
বিছানা থেকে বুকশেলফের উপর রেখে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতাটা বের করে বারান্দায়।
স্বপ্নের তাড়া খাওয়া একা বিষন্ন এ মানুষটা এ ভাষার অন্যতম প্রধান কবি হয়েও বৃষ্টি
নিয়ে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখেন নি।কিন্তু তবুও কি অবাস্তব সুন্দর সব উপমা।
“ভোর,
আকাশের
রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল”
চা
বানিয়ে কম্পিউটারটা চালু করলাম।সঙ্গীত শূন্য ‘বিষন্ন সময়’ পার করার মানে নেই।ভোর আর গভীর রাত
যন্ত্রসঙ্গীতের, ভোরে উঠে মানুষের কন্ঠ শুনতে ভালো লাগে না।Ricky King এর গিটার আর Brian Crain এর পিয়ানোর ট্র্যাকগুলো ছেড়ে লো ভলিউমে চুপচাপ শুনছি।
রুমমেটরা সব ঘুমাচ্ছে। ঘর ভরতি হয়ে উঠছে গিটার আর পিয়ানোর কোমল আওয়াজে ।
King এর Don’t cry
for me Argentina শুনতে
শুনতে মনে হলো বাইরে গেলে হয়, ঘুরে আসা যাক।
হলের
সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছদুটো দাড়ানো আসর শেষের যুগল নর্তকীর মতো। বৃষ্টিতে ভিজে ছোপ
ছোপ বাদামী বাকলের শরীর। মাথায় চিরোল চিরোল সবুজ পাতা আর আগুনে কমলা থোপা থোপা
ফুল।তরল প্রকৃতির পরিচ্ছন্ন বাতাস ঘুরে ঘুরে ছুয়ে দিচ্ছে। মন ভালো হয়ে গেলো।
নাস্তা
সেরে চা হাতে ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।কামিনী গাছটার দিকে তাকিয়ে সিগারেটটা ধরাতেই গতকাল পড়া ‘শুক্রবারের থিওরি’ মনে পড়লো। আপন মনে হাসলাম। তারপর
সিগারেটের ঠোঁটে আরেকটা লম্বা চুমু দিয়ে আরেকটু বিষ খেলাম।
তরুণীর
ঠোঁটে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ না হলে সিগারেটের ঠোঁটে চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ হবে
কেন?দুটোই তো সমান পোড়ায় আর জ্বালায়।সিগারেট তবু ভালো, নিজের ইচ্ছেয় জ্বালানো
পোড়ানো যায়। মাইথোলজিতে পড়া কিউপিডের বর্ণনা মাথায় আবৃতি হলো।আগুনের উপহার দেয়া
দেবশিশুর চেহারার চতুর সে দেবতা...
“He is cruel in his play,
Small are his hands yet his arrows fly far as death.
Tiny his shaft, but it carries heaven high.
Touch not his treacherous gifts, they are dipped in fire”
কিউপিডের
দেয়া ‘বিশ্বাসঘাতক উপহার
প্রেম’ আর ব্রিটিশ আমেরিকান
টোব্যাকোর দেয়া ‘ঘাতক
উপহার সিগারেট’
এ দুটোর মধ্যে কি মিল! দুটোই আগুনে চোবানো ভয়ংকর সুন্দর।বুক পুড়ে যাবে জেনেও জড়িয়ে
বাঁচার চেষ্টা।একটা ঘাতক, অন্যটা বিশ্বাসঘাতক।
সিগারেট
খাবার আসলে কোন যুক্তি নেই। ‘Smoking Kills’ এ সাবধানবানী পড়ার পরেও কেন মানুষ
সিগারেট খায় তা অধীশ্বর জানেন। যারা খায় তারা লোক বিশেষ ভালো না তা বলতে গেলে
ইতিহাস ঠেঙ্গাতে আসবে।পাইপ-চুরুট-সিগারেট ফোঁকা মহাপুরুষ তো আর কম নেই।( উল্টপীঠও আছে, ধূমপায়ী বদমাশও প্রচুর!
আয়নায় তাকালে একটাকে দেখি।)
সিগারেটের
রোমান্টিসিজমের শুরু আসলে কোথায় কে জানে? আমার নিজেরটা বলছি।
ইন্টারমিডিয়েটে
পড়া অবস্থায় কমিউনিজম নিয়ে অল্পবিস্তর পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। তো যে বীজে যে ফল।
নিউমার্কেট থেকে আমার তখনকার হিরো চে গেভারার একখানা পোস্টার কিনে নিয়ে এলাম।
দরজায় টানিয়ে প্রায়ই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। ছবিটা এরকম, বিপ্লবী কাওকে কোন একটা
নির্দেশ দিচ্ছেন হাত নেড়ে। তার বা হাতের মধ্যমা আর আঙ্গুরীর মাঝে একটা জ্বলন্ত
চুরুট।উদাসী হালকা দাঁড়ির মুখে ঠোটের কোনায় বিদ্রুপের হাসি।
বালক
আর কি করে! বালক রেড মারলবোরো কিনে ধরায়।অতঃপর শুরু।
রাজীব
বিশ্বাসের লেখার এত তত্ত্ব আর তথ্য ভালো না লাগলেও একটা কথা আসলেই সত্যি। সিগারেট
একবার ধরলে পুরোপুরি ছাড়া কঠিন, প্রায় অসম্ভব কাজ। মার্ক টোয়েন এর মতো অবস্থা হয়ে
যাবে।
আসলে
সিগারেট হলো কৈশোরের প্রথম প্রেমিকার মতো।দুঃখ কষ্ট পেলেই যার মুখ মনে পড়ে।তাই
মাঝরাতে একা লাগলে বারবার তার ঠোঁটে ফিরে আসার খেলা। ধরা আর ছাড়ার এই খেলা খেলতে
খেলতে জীবন পার হয়ে যাবে।
এজন্য,
নিশ্চিত ঘাতক বেছে না নিয়ে বিশ্বাসের জুয়া খেলুন বরং, ভাগ্যে থাকলে সহস্র বছরের
সাধনার ধন, একটি হৃদয় এক লহমায় পেয়ে যাবেন। আর কিছু পাগল ছাগল থাকবেই, যারা ‘খেলব না’ বলে উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাবে।এরা
বাতিল, এদের কথা বাদ দিন।