শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

ইদানীং জীবনযাপন (ভোর)

আজকাল খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়।  ঘুম ঘুম চোখে হোস্টেলের পুবমুখো বারান্দাটাতে  দাঁড়ানো মাত্র ভোর তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় স্বাগত জানায় । তাজা বাতাসের আদরে পাখির বুকের ওমের মত নরম আলোয় চারপাশের জীবন জেগে উঠতে থাকে। প্রতিটি ভোর আলাদাভাবে টের পাওয়া যায়। জলরং ছবিদের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে, প্রতিটা ভোরের আকাশেরও তেমন পার্থক্য থাকে। ঈশ্বর বুড়ো মনের আনন্দে তাঁর ক্যানভাসে আস্তে আস্তে লাল আর নীল জলরং এ ছবি আঁকা শুরু করেন। তাই বোধকরি প্রতিটা ভোরের  আকাশ আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে আসে। 

প্রাতঃকৃত্য সেরে ছাদে চলে যাই । ফাল্গুন পার হয়ে চৈত্রের শুরু । কলেজ ঘিরে থাকা পাতাঝরা মেহেগনী গাছগুলোয় ফাল্গুনের যে কচি পাতারা এসেছিলো  তারা এ চৈত্রের ভোরে যেন পূর্ণ যৌবন পেয়েছে। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের চিড়ল পাতায় বাতাসের অদ্ভুত আওয়াজ। পশ্চিমের উচু কড়ই গাছটায় যে চিলের পরিবারটি থাকে তারা পাম গাছের মাথাগুলোতে আর কড়ই এর মগডালে বসে ভোরের আলো দেখছে। এ চিলের পরিবারে কিম্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। মস্ত বড় একটা চিল একা একা সবচেয়ে উচু ডালটায় ধ্যানী মূর্তির মত দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসে থাকে। নড়াচড়া নেই আওয়াজ নেই। একা পাখিটার ভোর দর্শন বড় ভালো লাগে।

কমলা রঙ এর থালার মতো রাজসিক সূর্যটা আস্তে আস্তে পুবদিক থেকে মাথা তুলতে থাকে। দাড়কাকগুলো ইতস্তত ছাদের রেলিং এর দেয়ালে বসে আবার উড়ে যায়।ওপাশের দিঘির মত বড় পুকুরটায় কয়েকটা মাছরাঙ্গা আর সাদা বক উড়ে বেড়ায়।জলের উপর ওদের ছায়াগুলো দেখলে মনে হয় জলের ভেতরেও পাখিগুলো উড়ছে। জলের পাখিরা কি জলে তাদের উড়ন্ত শরীরের প্রতিবিম্ব দেখে বিস্মিত হয়। কে জানে?

 ভোর আরেকটু গাঢ হলে শালিকেরা আসে। কখনো জোড়ায় জোড়ায় , কখনো একাই। আর আসে ছোটবেলার প্রিয় পাখি বুলবুলি। ছেলেবেলায় প্রায় বনের মতো সুন্দর যে জায়গাটায় থাকতাম,সেটার টুকরো টুকরো ছবিগুলো মনে একের পর এক জলছবির মত ফুটে ওঠে। জীবনটা বুলবুলির ঝুঁটির মত সুন্দর লাগে এ অল্প সময়টুকুর জন্য।

অপরাজিত উপন্যাসের অপুর কথা মনে হয় বারবার,

In each of us a child has lived and a child has died, a child of promise who never grew up.

ভেতরের মরে যাওয়া শিশুটার সাথে যেন হুট করে দেখা হয়ে যায়। তাঁর হাসিমুখ দেখতে বড্ড ভালো লাগে। বড় হয়ে যাবার অপরাধে গ্লানিতে সংকুচিত কালসিটে পড়ে যাওয়া  মানুষটাকে কিছু সময়ের জন্য সে ক্ষমা করে । শিউলী ফুলের তাজা গন্ধের মতো শৈশব অবাক চোখে জীবনের পার হওয়া পথটাকে দেখে। কত নোংরা ,কত গ্লানিময় মুহূর্ত কত মাংসের চাহিদার উলঙ্গ সময়ের দাগ লেগে যাওয়া এ ধুলোমাটির জীবন । এসব সে শিশুকে স্পর্শ করতে পারে নি, পারবেও না। সে মরে গেছে অনেক আগে। তাঁর লাল গাড়ির ভাঙ্গা চাকাটার মত গড়িয়ে হারিয়ে গেছে কোথাও।  আর খুজে পাওয়া যায় নি।

সূর্য উঠে পড়ে পুরোপুরি। জীবনানন্দের ঘৃণিত দিনগুলো শুরু হয়। সূর্যের রোদে আক্রান্ত হয় পৃথিবী। রোদের তীব্র আলো এসে লাগে দেয়ালে দেয়ালে সাটানো রাজনৈতিক পোস্টারে ব্যানারে আর সিনেমার পোস্টারে বিশালবক্ষা  নায়িকার বুকের ছবিতে। সাধারন দিনের সাধারন চিন্তার বিষে মাতাল হয়ে যায় সময়।

ভোর একসময় শেষ হয় । আকাশ উজ্জ্বল দিনের ঘোষনা করে। ডানায় রোদের গন্ধ মাখতে পচে যাওয়া জীবনের প্রবাহ থেকে চিল উড়াল দেয় উদার আকাশে। কাকেরা আস্তাকুড়ে ময়লা ঘাটা শুরু করে।

পাখিরা তো চলে যায়। ছাদে ইতস্তত ঘুমিয়ে থাকা নোংরামাখা কুকুরগুলো আর আমি পড়ে থাকি। তারপর 'নীচে' নেমে আসি,  নিজের জীবনের মতোই।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন